দক্ষের শিব-নিন্দা শুনে সতী আর সইতে পারলেন না।
পতি-নিন্দা শুনি সতী জীবনে নৈরাশ,
ঘন-ঘন চক্ষে ধারা সঘনে নিশ্বাস;
পিতারে কুপিতা হইয়া অঙ্গ অবসান,
ধরা শয্যা করি ‘তারা’ ত্যেজিলেন প্রাণ!
সতী শিব-নিন্দা শুনে প্রাণত্যাগ করলেন, চারদিকে হাহাকার উঠল। সতীর সাতাশ বোন আকাশের তারা সব কাঁদতে লাগল, নন্দী কাঁদতে লাগল, ভৃঙ্গী কাঁদতে লাগল, দেবতারা কাঁদতে লাগলেন, মানুষেরা কাঁদতে লাগল—
ফিরে চাও মা বাঁচাও পরাণী,
ধূলাতে পতিত কেন পতিত-পাবনী;
দুটি নয়ন-তারা মুদিয়া তারা—
অধরা কেন ধরাসনে !
নন্দী গিয়ে কৈলাসে মহাদেবকে খবর দিলে—‘মা আর নেই।’ তখন শিব ক্রোধে হুহুঙ্কার ছাড়লেন, অমনি শিবদাস সব দক্ষযজ্ঞ নাশ করতে আগুয়ান হল। মহাদেব যুদ্ধে চললেন, পৃথিবী কাঁপতে থাকল, মেঘ সব গর্জন করে উঠল, আকাশে বিদ্যুৎ বাজ ছুটোছুটি করতে থাকল কড়মড় করে, শিব ত্রিশূল হাতে সাজলেন—
মহারুদ্র রূপে মহাদেব সাজে,
ভবম্বব ভবম্ভম সিঙ্গা ঘোর বাজে;
ফণাফণ ফণাফণ ফণী ফন্ন গাজে
মহারুদ্ররূপে মহাদেব সাজে;
ধকধ্বক ধকধ্বক জ্বলে বহ্ণি ভালে,
ববম্বম ববম্বম মহাশব্দ গালে;
ধিয়াতা ধিয়াতা ধিয়া ভূত নাচে
উলঙ্গী উলঙ্গে পিশাচী পিশাচে।
চলে ভৈরবা ভৈরবী নন্দী ভৃঙ্গী
মহাকাল বেতাল তাল ত্রিশৃঙ্গী,
চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে
চলে শাঁখিনী পেতিনী মুক্ত কেশে।
ভূত-প্রেত নিয়ে শিব এসে উপস্থিত। ভয়ে কারু মুখে কথা নেই, মহাদেব হুকুম দিলেন ভূতিয়া ফৌজকে—যজ্ঞনাশ কর। অমনি—
রুদ্রদূত ধায় ভূত নন্দি ভৃঙ্গি সঙ্গিয়া
ঘোরবেশ মুক্ত কেশ যুদ্ধ রঙ্গ রঙ্গিয়া,
যক্ষ রক্ষ লক্ষ লক্ষ অট্ট অট্ট হাসিছে
যজ্ঞগেহ ভাঙ্গি কেহ হব্যগব্য খাইছে,
প্রেতভাগ সানুরাগ ঝম্প ঝম্প ঝাঁপিছে,
ঘোররোল গণ্ডগোল চৌদ্দলোক কাঁপিছে ;
ভূত ভাগ পায় লাগ লাথি কিল মারিছে
বিপ্র সর্ব দেখি খর্ব ভোজ্য বস্ত্র সারিছে
ভার্গবের সৌষ্ঠবের দাড়ি গোঁফ ছিণ্ডিল
পুষণের ভূষণে দন্ত পাঁতি পড়িল,
ছাড়ি মন্ত্র ফেলি তন্ত্র মুক্ত কেশ ধায় রে,
হায় হায় প্রাণ যায় পাপ দক্ষ দায় রে!
নৈবিদ্যির থালা ফেলে বিশ্বামিত্র দৌড়—বশিষ্ঠ চম্পট, সবার দাড়ি গোঁফ ছিঁড়ে কিলিয়ে দাঁত ভেঙে ভূতেরা লম্ফ-ঝম্প করতে লাগল—
মৌনী তুণ্ড হেঁট মুণ্ড দক্ষ মৃত্যু জানিছে
মৈল দক্ষ, ভূত যক্ষ সিংহনাদ ছাড়িছে।
দক্ষ-নিপাত দেখে সতীর মা কেঁদে শিবকে বললেন—
সতীর জননী আমি, শাশুড়ী তোমার,
তথাপি বিধবা দশা হইল আমার?
প্রসূতির বাক্যে শিব সলজ্জ হইল,
রাজ্যসহ দক্ষরাজে বাঁচাইয়া দিল।
ধড়ে মুণ্ড নাহি দক্ষ দেখিতে না পায়,
উঠে পড়ে ফিরে ঘুরে কবন্ধের প্রায়—
কন্দ-কাটা দক্ষের দুর্গতি দেখে ভূতেরা সব হাসতে লাগল, তখন শিবের হাতের কাছে ছিল পাহাড়ি একটা রামছাগল দড়ি দিয়ে হাড়-কাঠে বাঁধা। তিনি সেইটে নন্দীকে দেখিয়ে দিলেন। নন্দী তার মুড়োটা কেটে দক্ষের কাঁধে জুড়ে দিয়ে দক্ষ প্রজাপতির ডানা দুটো কেটে নিয়ে চলে গেল, শিব সতীদেহ নিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে কৈলাসে গেলেন! এর পরে আরও কথা আছে, কিন্তু এইখানেই দক্ষযজ্ঞ শেষ—হরি হরি বল সবে পালা হৈল সায়—বলে রিদয় চুপ করলে।
রামছাগল ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকালে, খানিক চেয়ে থেকে বললে— “ফুঃ, এমন আজগুবি কথা তো কখনো শুনিনি। বুড়ো হয়ে শিং ক্ষয়ে গেল, এমন কথা তো কোনোদিন শুনলেম না যে প্রজাপতির মাথা হয় রামছাগলের মতো আর পাহাড়গুলোর গজায় ডানা!”
রামছাগল ছেলেদের বললেন:
ওসব বাজে কথায় বিশ্বাস কর না, বড় হয়ে মধুর সন্ধানে পেটের দায়ে তোমরা জানি দেশ-বিদেশে যাবে, এমন অনেক বাজে গল্পও তোমাদের এই দেশের পাহাড়-পর্বত নদ-নদীর নামে শুনতে পাবে। কেউ বলবে তোমার দেশ মন্দ, কেউ বলবে মন্দ নয়, কিন্তু মনে রাখ, এই হিমালয়ের জলে বাতাসে তোমরা মানুষ, ভগবান তোমাদের জন্যে সব চেয়ে ভালো, সব চেয়ে উঁচু, সব চেয়ে চমৎকার বাড়ি দিয়েছেন। এই কথাটি সর্বদা মনে রেখ, কোনোদিন ভুলো না যে পৃথিবীর সেরা হচ্ছে এই হিমালয়, আর সেইটে ভগবান দিয়েছেন তাঁর কালো ছেলেদের। এই পাথরের সিঁড়ি এতকালের পুরোনো যে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আগে এটা, তারপর গাছ পালা, জন্তু-জানোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। পাখির ছানাগুলো জন্মাবার আগে যেমন তাদের বাসা তৈরি হয়ে থাকে, মানুষদের, জানোয়ারদের জন্মাবার আগে তেমনি জগৎমাতা আর বিশ্বপিতা তাদের জন্যে এই চমৎকার হিমালয় আর সমুদ্র পর্যন্ত গেছে যে পাঁচ ধাপ পাথরের সিঁড়ি, তা প্রস্তুত করিয়েছিলেন। জীব-জন্তুরা জন্মে যাতে আরামে থাকে, কষ্ট না পায় সেই জন্যে চমৎকার করে পাথর দিয়ে দালান রক এমনি সব নানা ঘর নানা বাড়ি তাঁরা সুন্দর করে বাঁধিয়ে দিলেন!
কিন্তু কত কালের এই বাড়ি, একে পরিষ্কার রাখা, মেরামতে রাখা, যারা জন্মাতে লাগল তাদের তো সাধ্য হল না, এককালের নতুন বাড়ি পাথরের সিঁড়ি সব ভেঙে ফেটে পড়তে লাগল, বর্ষায় এখানে-ওখানে সোঁতা লাগল, শেওলা গজাল, হাওয়াতে ধুলো-মাটি এসে ধাপগুলোতে জমা হতে থাকল, ঝড়ে ভূমিকম্পে বড়-বড় পাথর খসে-খসে এখানে-ওখানে পড়ল, এখানটা ধ্বসে গেল, সেখানটা বসে গেল, ওটা ভেঙে পড়ল, সেটা বেঁকে রইল, এইভাবে কালে-কালে ধাপগুলোর উপরের তলার মাটি তাকে ধুয়ে নিচের তলায় নামতে লাগল; আর ধাপে-ধাপে সেখানে যেমন মাটি পেলে নানা জাতের গাছপালা বন-জঙ্গল দেখা দিলে। উপর-তলার মাটি ধুয়ে গেছে সেখানে কাঁকর আর নুড়িই বেশি, তার পরের ধাপে অল্প মাটি আছে সেখানে অল্পসল্প চাষবাস চলেছে দেখ, খুব ছোট-ছোট খেত, ছোট গ্রাম। মাঝের ধাপে অনেকটা মাটি জমা হয়েছে। সেখানে দেখ দর্জ্জিলিঙ শহর বাড়ি-ঘর বাজার চা-বাগান। কোম্পানীর বাগান সব বসে গেছে, উপর-তলার মতো অতটা ঠাণ্ডাও নয়, কাজেই সেখানে নানা গাছ ঝাউ বাদাম আখরোট পিচ পদম সব তেজ করেছে। নানা ফুলও সেখানে!