বিশ্বকর্মা ইন্দ্রকে বললেন—‘বাজ দিয়ে মন্দর পর্বতের ডানা কেটে দাও!’ ডানা কাটা গেল, মন্দর সমুদ্রেই ডুবে রইল আর তার ডানার কুচিগুলো এখানে-ওখানে সমুদ্রের মাঝে টাপুর মতো ভাসতে লাগল। বিশ্বকর্মা সেগুলোর উপরে মাটি ছড়িয়ে দিলেন, বসতি বসিয়ে দিলেন। তারপর বিশ্বামিত্র যত ডানা গড়ে রেখেছিলেন সেগুলো দিয়ে বিশ্বকর্মা প্রজাপতি ভোমরা মৌমাছি সব গড়ে ছেড়ে দিলেন। তারা দেশ-বিদেশ থেকে ফুলের রেণু ফুলের মধু এনে পাহাড়ে-পাহাড়ে বাগান বসাতে শুরু করে দিলে। দেখতে-দেখতে পাথরের গায়ে সব ফুল গজাল ফল ফলল। সব ঠিক করে বিশ্বকর্মা প্রকাণ্ড দুই ডানা দিয়ে দক্ষ প্রজাপতি ছিষ্টি করে হাত-পা ধুয়ে ভাত খেতে গেলেন, শাস্তরের ছিষ্টিতত্ত্ব তো এই হল, তারপর দক্ষ প্রজাপতির কথা পুরাণে লিখেছে যেমন, বলি, শোনো—
বিধির মানস সুত দক্ষমুনি মজবুত
প্রসূতি তাহার ধর্ম-জায়া।
তার গর্ভে সতীনাম অশেষ মঙ্গলধাম
জনম লভিলা মহামায়া।
নারদ ঘটক হয়ে নানামতে বলে কয়ে
শিবেরে বিবাহ দিল সতী।
নারদ তো ঘটকালি নিয়ে সরে পড়লেন, এদিকে শিব ষাঁড়ে চড়ে ভুটিয়ার দলের সঙ্গে ডমরু বাজিয়ে জটায় সাপ জড়িয়ে হাড়মালা গলায় ঝুলিয়ে নাচতে-নাচতে হাজির।
দক্ষ প্রজাপতি বরের চেহারা দেখেই চটে লাল—
শিবের বিকট সাজ
দেখি দক্ষ ঋষিরাজ
বামদেবে হৈল বাম-মতি।
সেই থেকে জামাই শ্বশুরের মুখ দেখেন না। দক্ষ প্রজাপতিও শিবনিন্দে না করে জল খান না। এই সময়ে দক্ষ শিবহীন যজ্ঞ করলেন; সব দেবতা নেমন্তন্ন পেলেন। সতীর বোনেরা গয়না-গাটি পরে পালকি চড়ে শিবের বাড়ির সামনে দিয়ে ঝমর-ঝমর করতে-করতে বাপের বাড়ি মাছের মুড়ো খেতে চলল দেখে সতীর চোখে জল এল। দুঃখী বলে বাবা তাঁদের নেমস্তন্ন পাঠাননি!
সতী বোনেদের পালকির কাছে গিয়ে দিদির গলা ধরে কেঁদে বললেন:
অশ্বিনীদিদি! আমারে দুখিনী দেখিয়া পিতে
অবজ্ঞা করিয়া যজ্ঞে আজ্ঞা না করিলেন যেতে,
নিজ বাপ নহে অন্য শুনে হৃদে এই ক্ষুণ্ণ
আমা ভিন্ন নেমন্তন্ন করেছেন এই ত্ৰিজগতে ।
অশ্বিনীদিদি আঁচলে সতীর চোখের জল মুছিয়ে বললেন—‘তুই চল না। বাপের বাড়ি যাবি তার আবার নেমন্তন্ন কিসের? আয় আমার এই পালকিতে!’
সতী ঘাড় নেড়ে বললেন—‘না ভাই—তিনি রাগ করবেন!’
‘তবে তুই তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পরে আয়’—বলে সতীর দিদিরা—
চতুর্দোলে সবে চড়ি চলিলেন হরষে
হেথায় শঙ্করী ধেয়ে করপুটে দাণ্ডাইয়ে
চরণে প্রণতি হয়ে কহিলেন গিরিশে
আমি বাপের বাড়ি যাব!
শিব বললেন—
সতী তুমি যেতে চাচ্ছ বটে,
পাঠাইতে না হয় ইচ্ছা দক্ষের নিকটে।
আমাদের শ্বশুর জামায়ে কেমন ভাব, শোনো—
আমাদের ভাব কেমন জামাই শ্বশুরে, যেমন দেবতা আর অসুরে,
যেমন রাবণ আর রামে, যেমন কংস আর শ্যামে,
যেমন স্রোতে আর বাঁধে, যেমন রাহু আর চাঁদে,
যেমন জল আর আগুনে, যেমন তেল আর বেগুনে,
যেমন পক্ষী আর সাত নলা, যেমন আদা আর কাঁচকলা,
যেমন ঋষি আর জপে, যেমন নেউল আর সাপে,
যেমন ব্যাঘ্র আর নরে, যেমন গোমস্তা আর চোরে,
যেমন কাক আর পেচক, যেমন ভীম আর কীচক।
দক্ষ যখন অমান্য করে বারণ করেছেন নিমন্ত্রণ, কেমন করে সেখানে তোমার যাওয়া হয়!’
সতী কিন্তু শোনেন না শিবের কথা, তিনি সেজেগুজে নন্দীকে সঙ্গে নিয়ে মহাদেবের ষাঁড়ে চড়ে বাপের বাড়ি চললেন দুঃখিনী বেশে। কুবের দেখে বাক্স-ভরা এ-কালের সে-কালের গহনা এনে বললে—‘মা, এমন বেশে কি যেতে আছে! বাপের বাড়ির লোকে বলবে কি—ওমা, একখানা গয়নাও দেয়নি জামাই!’ সতী কুবেরের দেওয়া গহনা পরে সাজলেন; কিন্তু দক্ষ প্রজাপতির কন্যা সতী এমন সুন্দরী যে সোনা হীরে তাঁর সোনার অঙ্গের আলোর কাছে টিম-টিম করতে লাগল। ‘দূর ছাই’ বলে সতী সেগুলো ফেলে দিয়ে পাহাড়ি ফুলের সাজে সেজে বার হলেন। ত্রিলোক সতীর চমৎকার বেশ দেখে ধন্য-ধন্য করতে-করতে সঙ্গে চলল।
এদিকে ছোট মেয়ে সতী এল না, কাজের বাড়ি শূন্য ঠেকছে, সতীর মা কেবলি আঁচলে চোখ মুচছেন এমন সময় দাসীরা এসে প্রসূতিকে খবর দিলে—‘ওমা তোর সতী এলো ঐ!’ এই শুনে—
রানী উন্মাদিনী-প্রায়
কৈ সতী বলিয়া অতি বেগে তথা ধায়।
অম্বিকারে দৃষ্টি করি বাহিরেতে এসে
আয় মা বলে লইয়া কোলে
নয়ন জলে ভাসে!
সতী মায়ের কাছে বলে একটু দুধ সন্দেশ খেয়ে সভা দেখতে চললেন। ইন্দ্র চন্দ্র সব বসেছেন, বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠ সব বসেছেন দক্ষ প্রজাপতিকে ঘিরে, আর কালোয়াত সব গান-বাজনা করছে—
ধির্ কুট্ কুট্ তানা নানা তাদিম তা, তা দিয়ানা ঝেন্না ঝেন্না
নাদেরে দানি তাদেরে দানি, ওদেরে তানা দেরে তানা
তাদিম তারয়ে তারয়ে দানি ।
দেতারে তারে দানি ধেতেনে দেতেনে নারে দানট।
বেশ গান-বাজনা চলেছে—এমন সময় সভাতে সতীকে আসতে দেখেই দক্ষ শিব নিন্দে শুরু করলেন। দক্ষ প্রজাপতি :
কেবল এ গ্রহ আনি নারুদে ঘটালে,
কনিষ্ঠা কন্যাটা আমি দিলাম জলে ফেলে;
বস্ত্রবিনা বাঘছাল করে পরিধান,
দেবের মধ্যে দুঃখী নাই শিবের সমান।
ভূত সঙ্গে শ্মশানে-মশানে করে বাস,
মাথার খুলি বাবাজীর জল খাবার গেলাস!
যায় বলদে বসে গলদেশে মালাগুলো সব অস্থি,
সিদ্ধি ঘোঁটার সদাই ঘটা বুদ্ধি সেটার নাস্তি;
অদ্ভুত সঙ্গেতে ভূত গলায় সাপের পৈতে,
তারে আনিলে ডেকে হাসিবে লোকে—তাই হবে কি সইতে !
পাগলে সম্ভাষা করা কোন প্রয়োজন,
সাগরে ফেলেছি কন্যা বলে বুঝাই মন।