চকা আমনি বলে উঠল—“আমি জানি। নীল সমুদ্রের মাঝে পাহাড় আছে, টাপু আছে, তার পরে পৃথিবীর শেষ বরফের দেশ, সেখানে বারোমাস বরফ, জমি যেন শাদা চাদরে ঢাকা আর সেখানে ছ’মাস রাত্রি ছ’মাস দিন; সেখানে পেঙ্গু পাখিরা বরফের বাসায় ডিম পাড়ে, ধলা ভালুক আছে, ধলা শেয়াল সিন্ধুঘোটক আছে, সব সেখানে শাদা, কালো কিছু নেই, দিন রাত সমান আলো, ঘুটঘুটে আঁধার মোটেই নেই, আমি সেখানে পাঁচবার গেছি!”
চকার কথায় রামছাগল শিং বেঁকিয়ে বল্লে—“এত বুড়ো হলেম এমন আজগুবি কথা তো শুনিনি।”
রিদয় এবার এগিয়ে এসে বললে—“যে হিমালয়ের চূড়ো এখান থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বরফে ঢাকা, ঐ হিমের বাড়ি গড়া নিয়ে কি কাণ্ড হয়ে গেছে এককালে, তার খবর চকা তো জানে না, রামছাগলও জানে না, মানুষেরা ধ্যান করে ওই নিচের তলাকার বনে বসে। ওই ধবলগিরির উপরের খবর যা শাস্তরে লিখে গেছে—তাই বলছি, শোনো। বড় চমৎকার কথা!”
সবাই অমনি রিদয়কে ঘিরে বসল কথা শুনতে, মেঘলা দিন ভিজে স্যাঁৎস্যাঁত করছে, ভালুকের গা ঘেঁষে ছাগল, ছাগলের গা ঘেঁষে হাঁস, হাঁসের গা ঘেঁষে শেয়াল।
রিদয় গল্প শুরু করলে:
হিমালয় কেমন, তা শুনলে! হিমালয়ের উপরে কি নিচে কি সমুদ্রের এপারে কি ওপারে কি সবই তো শুনলে, কিন্তু এগুলো তৈরি করলে কে, তার খবর রাখ? প্রথমে সেইটে বলি, শোনো—একদিন বিশ্বকর্মা গোলার মতো একতাল কাদা পাকিয়ে নতুন পৃথিবী গড়তে বসলেন। চন্দ্র সূর্য গড়া হয়েছে এইবার সসাগরা আমাদের এই ধরা তিনি গড়তে আরম্ভ করলেন। সেদিনটাও এমনি আঁধার-আঁধার ছিল। বিশ্বকর্মার আর কাজে মনই যাচ্ছে না, তিনি কাদা নিয়ে কেবলি পৃথিবীটার উপরে বুড়ো আঙুলের টিপ দিয়ে এদেশ-সেদেশ গড়ে চললেন, সব দেশ মিলিয়ে দেশ-বিদেশগুলোর চেহারাটা হল ঠিক যেন হাড্ডিসার—এখানে-ওখানে মাটি-ঝরা শিক-বারকরা বাঁকা-চোরা টোল-খাওয়া দোমড়ানো চোপসানো গরু, ঘাড় ঝুঁকিয়ে সমুদ্রের জল খাচ্ছে আর ঠিক তারি সামনে একটা গরুড় পক্ষীর ছানা সেও যেন গো-ডিম থেকে সবে বার হয়ে মাছ ধরবার জন্যে সমুদ্রের দিকে গলা বাড়িয়েছে!
বিশ্বকর্মার পাশে বিশ্বামিত্র বসেছিলেন; তাঁর বিশ্বাস, বিশ্বকর্মার চেয়ে গড়ন-পিটন করতে তিনি পাকা। বিশ্বকর্মার সঙ্গে বাজি রেখে প্রায়ই বিশ্বামিত্র এটা-ওটা গড়তেন, প্রত্যেক বারে বাজিও হারতেন কিন্তু তবু তাঁর বিশ্বাস গেল না যে বিশ্বকর্মার চেয়ে তিনি পাকা কারিগর! বিশ্বকর্মার ছিষ্টি মিষ্টি আতা খেয়ে বিশ্বামিত্র এক আতা গড়লেন, দেখতে বিশ্বকর্মার আতার চেয়েও ভালো কিন্তু সমুদ্রের জল দিয়ে গড়বার কাদা ছানার দরুন বিশ্বামিত্রের আতা এমনি নোনা হয়ে গেল যে মুখে দেবার যো নেই! ডিম ফুটে পাখি বেরোচ্ছে বিশ্বকর্মা ছিষ্টি করলেন, পাখিদের মা-বাপ— তাদের ডিম, ডিমের মধ্যে বাচ্চা—বিশ্বামিত্র বললেন, ‘ও কি হল? এ কি আবার একটা ছিষ্টি! আমি গাছে পাখি ফলাব।’ বিশ্বামিত্র অনেক মাথা ঘামিয়ে অনেক আঁক-জোক কষে স্থির করলেন—ডিমে তা দেওয়া চাই কিন্তু পাখি তা দিলে তো চলবে না—তিনি এমন নারকোল গাছ সুপুরি গাছ তাল গাছ ছিষ্টি করলেন যাতে দিন ভোর রোদ পায়, কিন্তু বেশি রোদ পেলে ডিম একেবারে সিদ্ধ হয়ে যাবে, আবার রাতে হিম পেলেও নষ্ট হবে, জল পেলে পচে যাবে! সব ভেবে-চিন্তে বিশ্বামিত্র বড়-বড় পাখির পালকের মতো পাতা গাছের আগায় বেঁধে দিয়ে সেই পাতার গোড়ায় দশটা বারোটা কুড়িটা পঁচিশটা করে ছোট-বড় নানা রকম ডিম ঝুলিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন পাখি বার হয়, কিন্তু পাছে কাগে চিলে ঠুকরে ডিমগুলো ভেঙে দেয় সেজন্যে বিশ্বামিত্র ডিমের খোলাগুলো এমনি শক্ত করে বানিয়েছেন যে বাচ্চা পাখি সেই পুরু নারকোল মালা নারকোল ছোবড়া তালের খোলা সুপুরির ছাল ভেঙে বার হতেই পারলে না। কোনোটা রোদে পক্ক কোনোটা অর্ধপক্ক কোনোটা অপক্কই রয়ে গেল। ডিম হল, তার শাঁস জল হল, তা দেওয়া হল, সবই হল, কিন্তু তা থেকে পাখি হল না!
এতেও বিশ্বামিত্রের চৈতন্য হল না। বিশ্বকর্মাকে গোরূপা পৃথিবী গড়তে দেখে তাঁরও গড়বার সাধ হল। তখন বিশ্বকর্মা গোরূপা পৃথিবীর বাঁটের মতো এই ভারতবর্ষটি অতি যত্ন করে গড়ছেন, সব তখনো গড়া হয়নি কিন্তু এতেই মনে হচ্ছে এই দেশটি হবে চমৎকার, একেবারে কামধনুর বাঁটের মতো দেশটি—যা চাই যত চাই এখানে পাওয়া যাবে। বিশ্বামিত্র তাড়াতাড়ি একটু কাদা নিয়ে বসে বললেন, ‘দাদা তুমি খানিক এই দেশটার গড়, আমিও খানিক গড়ি—দেখা যাক কার ভালো হয়।’ বিশ্বকর্মা ভারতবর্ষের আদড়াটা প্রায় শেষ করেছিলেন কাজেই বিশ্বামিত্র খারাপ করে দিলেও দেশটা একেবারে মাটি হয়ে যাবে না জেনে দেশটার উপরে বিশ্বামিত্রকে গড়া পেটা করতে দিতে বিশ্বকর্মা আপত্তি করলেন না। তাঁকে সমস্ত উত্তর দিকটা গড়তে ছেড়ে দিয়ে নিজে বাঙলাদেশটা গড়তে বসে গেলেন। বাঙলাদেশটা সুন্দর করে নদী গ্রাম ধানখেত সুন্দর বন আম কাঁঠালের বাগান খড়ের চাল দেওয়া ছোট-ছোট কুঁড়ে ঘর দিয়ে চমৎকার করে সাজিয়ে তুলতে বিশ্বকর্মার বেশি দেরি লাগল না, বুড়ো আঙুলের দু’চার টিপ দিয়ে মাঠগুলো আর আঙুলের দাগ দিয়ে নদী-নালা বানিয়ে তিনি কাজ শেষ করে বসে বিশ্বামিত্রের দিকে চাইলেন। বিশ্বামিত্র অমনি বলে উঠলেন,—‘আমার কাজ অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে, দেখবে এস।’