রবতেন ডাণ্ডিখানা জানলার ধারে বারাণ্ডায় রেখে চলে গেল। রিদয় সে রাত ডাণ্ডির ছৈটার মধ্যে কাটিয়ে বাবুর সঙ্গে লুকিয়ে যেমন এসেছিল, তেমনি ডাণ্ডিতে লুকিয়ে রওনা হল। পুতুলের মধ্যে টুনুর পুতুলটাই পাওয়া গেল, সুরূপার পুতুলটা নিশ্চয় টমা মুখে করে কোথায় ফেলেচে বলে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান হল না! সুরূপা টমার পিঠে দুই থাবড়া বসিয়ে পাহাড়ের উপর পা ছডিয়ে কাঁদতে লাগল।
আলুবাড়ি থেকে রিদয়কে পিঠে নিয়ে জালা-পাহাড় কাট-পাহাড় পেরিয়ে হাঁসেরা এমন মেঘ আর শিলা-বিষ্টি পেলে যে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকেই এগোতে পারলে না, তাড়াতাড়ি ঘুরে ঝুপ-ঝাপ ঘুম-লেকে গিয়ে পড়ল। ভয়ঙ্কর শিল পড়েছে, লেকেৱ জলের উপরে বরফের সর পড়ে গেছে, পাহাড়ের গা বরফে শাদা হয়ে গেছে, খোঁড়া হাঁসের পায়ের বাত কটকট করে উঠল। সে বললে—“কাজ নেই বাপু এখানে থেকে, ফিরে চল, আর একবার আসা যাবে।” কিন্তু চল বললেই বলা চলা যায় না—পাহাড় দেশে মেঘ ভালো হওয়ার গতিক বুঝে তবে চলাচল করতে হয়। কোনো রকমে পাঁপড়া পানকৌড়ি ঘুম-রকে চড়ে আকাশের ভাবটা জেনে আসতে চলল; অমনি রিদয় বললে—“আমি যাবো ঘুম-রকে।” খোঁড়া বললে—“আমিও।” অমনি সবাই একসঙ্গে—“আমিও-আমিও” বলতে-বলতে উড়ে গিয়ে রকের উপরে বসল।
মানুষের বাড়িতে যেমন কোনো জায়গা রাঁধবার, কোনটা বৈঠকখানা, কোনটা বা শোবার-খাবার জায়গা, হিমালয়েতেও তেমনি এক-একটা জায়গা এক-এক কাজের জন্যে আছে। মানুষের বাড়িেত যেমন দালান থাকে বারাণ্ডা থাকে রক থাকে, হিমালয়েতেও তাই। ঘুম-রকটা হল ঘুম দেবার স্থান, জলাপাহাড় হল জল খাবার কিম্বা জলো হাওয়া খাবার জায়গা, রংটং হল ধোবিখানা, কাপড় রঙাবার জায়গা, টুং হল ঘড়ির ঘর, এমনি সব নানা রক নানা দালান চাতাল গুহা এক-এক কাজের জন্যে রয়েছে।
ঘুম-রকে দিনে বড় কেউ আসে না, দু’চার পথিক পাখি কি জানোয়ার কখনো-কখনো জিরোতে বসে, না হলে জায়গাটা সারাদিন ফাঁকা থাকে দেখে বুড়ো রামছাগল মাস্টার এখানে ছানা পড়াবার জন্যে একটা ইস্কুল খুলেছেন। পাখির-ছানা শেয়াল-ছানা শুয়োর-ছানা ভালুক-ছানারা ঘুম-রকে বড়-বড় পাথরের বেঞ্চিতে কেউ পা ঝুলিয়ে কেউ বা বেঞ্চিতে দাঁড়িয়ে সারাদিন ঝিমোচ্ছে আর রাম-ছাগল শিংয়ের খোঁচায় তাদের জাগিয়ে দিয়ে কেবলি পড়াচ্ছেন, ক, খ, গ, ঐ ব্যে স্যে! একে ঘুম-রক তাতে আজ বড় বাদলা, শিংয়ের খোঁচা খেয়েও চুনে-চুনে পড়ছে দেখে রামছাগলও কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমের যোগাড় করছেন এমন সময় রিদয়কে নিয়ে হাঁসেরা উপস্থিত। অচেনা লোক দেখে মাস্টারমশায় তাড়াতাড়ি গা ঝাড়া দিয়ে মস্ত ম্যাপ আঁকা প্রকাণ্ড কালো সেলেটখানায় শিং বুলিয়ে-বুলিয়ে ছেলেদের জিওগ্রাফির লেকচার শুরু করলেন:
জলের জন্তুরা চোখ ফুটেই দেখে জল আকাশ, ডাঙ্গার জীব তারা দেখে বন-জঙ্গল মাঠ, আর পাহাড়ের ছেলেমেয়ে তারা দেখে আকাশের উপরে বরফে ঢাকা ওই হিমালয়ের চুড়ো ক’টা। হিম-আলয় সন্ধি করে হয়েছে হিমালয় অর্থাৎ কিনা হিমালয় মানে হিমের বাড়ি, পাহাড়ি ভাষায় বলে হিমাল, সমস্কৃতোতে বলবে হিমাচলম্, ইংরেজ তারা ভালো রকম উচ্চারণ করতেই পারে না, ‘র’ বলতে ‘ল’ বলে ফেলে—তারা হিমালয়কে বলে ইমালোইয়াস্! হিমালয়ের মতো উঁচু আর বড় পর্বত জগতে নেই। সব দেশের সব পর্বত আমাদের হিমালয়ের চূড়োর কাছে হার মেনেছে।
ধলা চামড়া জানোয়ারেরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে, আমাদের বলে কালো, কিন্তু তাদের সব চেয়ে বড় পাহাড় মোটে ষোলো হাজার ফুট আর আমাদের এই বাড়ির চূড়োগুলো কত উঁচু তা জানো? এর চল্লিশটা শিখর হচ্ছে চব্বিশ হাজার ফিট করে এক-একটি। ঐ কাঞ্চনঞ্জঙ্ঘা যেটা সকালে-সন্ধ্যায় সোনা আর দিনে-রাতে রুপো, ওটা হচ্ছে আটাশ হাজার ফুট, ওরও আরো হাজার ফুট উপরে ধবলগিরির সব উঁচু চূড়ো ঊনত্রিশ হাজার ফুট। এর পাশে ধলা চামড়াদের জেতো পাহাড়—ফুঃ, রাজহস্তীর পাশে খরগোস! মানুষের কথা দূরে থাক পাখিরাও এই হিমালয়ের চূড়োয় চড়তে পারে না, এখানে না ঘাস না গাছ! মেঘ পর্যন্ত ভয় পায় সেখানে উঠতে, শুধু ধপধপ করছে আছোঁয়া শাদা বরফ।
এই হিমালয়ের চূড়ো থেকে বরফ গলে বারোটা মহানদী ছিষ্টি হয়ে পুব-পশ্চিমে দুই মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে, কত দেশ কত বনের মধ্যে দিয়ে তার ঠিক নেই। এ-সব নদীর ধারে কত নগর কত গ্রাম কত মাঠ-ঘাট জমি-জমা রাজ্য পেতে কত রকমের মানুষরা রয়েছে তা গোনা যায় না।
এই হিমের বাড়ির চূড়োটা থেকে ধাপে-ধাপে পৃথিবীর দিকে নেমে গেছে প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড পর্বত-প্রমাণ সিঁড়ি, এক-এক ধাপে রকম-রকম গাছ-পালা পশু-পাখি! এ রকে সে রকে পাথরের কাজাল এমন চওড়া যে সেখানে কতকালের পুরোনো পাথরের মেঝেতে বড়-বড় গাছের বন হয়ে রয়েছে, ঝরনা দিয়ে বর্ষার জল বরফের জল সব গড়িয়ে চলেছে। কোনো রকের উপর দিয়ে মানুষেরা রেল চালিয়ে দিয়েছে, বড়-বড় শহর বসিয়ে বাজার বসিয়ে রাজত্ব করছে।
জীব-জন্তুর অগম্য স্থান ধবলাগিরি, সেখানে কেবলই বরফ। এই সিঁড়ির রক, যাতে আমরা বাস করছি, এরি সব উপরের রকে শুধু বরফ আর শেওলা, একমাত্র চমরী গাই পাহাড়ি ছাগল আর ভেড়া, তার পরের ধাপে মানুষ-সমান ঘাস আর দেবদারু বন, সেখানে শেয়াল ভালুক হেঁড়েল এরাই যেতে পারে, তার পরের রকে নানা ফুল ফলের বাগান, সেখানে প্রজাপতি পাখি খরগোস কুকুর বেড়াল ভোঁদড় ভাম বাঁদর হনুমান এরাই থাকে, সবশেষের ধাপে বেতবন বাঁশবন অন্ধকার ঘন জঙ্গল, সেখানে হরিণ মোষ বাঘ সাপ ব্যাঙ্ তার পরে চাটালো জমি যার উপর দিয়ে সহস্রধারা নদী সব বয়ে চলেছে, এরি পরে অগাধ সমুদ্র, নীল জল, শেষ দেখা যায় না, এই সমুদ্রের ওধারে যে কি, তা কেউ জানে না!