বাঁ-ধারে দূরে কালে-কালো পাহাড়ের শিখরে বরফের পাহাড় যেন দুধের ফেনার মতে উথলে পড়েছে। একদল বাঙালী বৌ ছেলে-পুলে নিয়ে কার্সিয়ংয়ের ইষ্টিসনের উপরের রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছে—গিন্নি সবে অসুখ থেকে উঠেছেন, তিনি ছাতি মাথায় দাণ্ডি চেপে চলেছেন, কর্তা লাঠি ধরে সঙ্গে, পিছনে চার মেয়ে, ছোট-বড় তিন ছেলে, এক বৌ, দুই জামাই, একপাল নাতি-পুতি হাসি-খুশি লুটো-পাটি করে চলেছে! কেউ পাহাড় থেকে ফুল তুলছে, কেউ রাস্তা থেকে নুড়ি কুড়োচ্ছে, একটা ছেলের হাতে প্রজাপতির কুড়োজাল দেখে রিদয় চেঁচিয়ে বললে—“ধর না ধর না, যক্ হবে।”
হাঁসেরা বলে চলল—“ফুল যত চাও তোল, গোলাপ ফুটল বলে, গাঁদা ওই ফুটেছে, চেরি ফুলে রঙ ধরেছে, আমরা এনেছি, নাও কলাই-শুটি নাও, ফুলকপি নাও, আপেল নাও, নাসপাতি যত পার খাও নাও দাও থোও, প্রজাপতি ধরা ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও!”
দেখতে-দেখতে মেঘে কার্সিয়ং ঢেকে গেল, ছেলে-বুড়ো ঘর-বাড়ি বাজার-ইষ্টিশান মায় ছোট রেল গিদা পাহাড় ডাউনহিল সব কুয়াশায় চাপা পড়লো, দূরে সিঞ্চল মেঘের উপরে মাথা তুলে দেখা দিল। এইবার রিদয়ের শীত আরম্ভ হল। খোঁড়া হাস ডানা ছড়িয়ে উড়ে চলেছে, পালকের মধ্যে ঢোকবার যো নেই, জলে-শীতে থরথর করে বেচারা কাপতে লাগল, খোঁড়াও বাঙলাদেশের মানুষ, পাহাড়ের শীতে তারও ডানার পালকগুলো কাটা দিয়ে উঠল, সে ডাক দিলে—“শীত-শীত হংপাল শীতে গেল!”
চকা হাঁকলে—“নেমে পড় কার্সিয়ং!”
হাঁসরা অমনি মেঘের মধ্যে দিয়ে নামতে শুরু করলে। রিদয় দেখলে, মেঘের মধ্যেটায় খোলা আকাশের চেয়ে কম ঠাণ্ডা, যেন পাতলা তুলোর বালাপোষ গায়ে দিয়েছে। হাঁসেরা নামতে-নামতে একটা বাড়ির ছাতে এসে বসল। বাড়ির বাইরে কেউ নেই, কুয়াশার ভয়ে সবাই ঘরে কাঁচ বন্ধ করে বসেছে, বাইরে কেবল গালফুলো একটুখানি একটা পাহাড়ি ছোঁড়া আগুন জ্বেলে কচি ছেলের একজোড়া পশমের মোজা তাতিয়ে নিচ্ছে, আর সেই সঙ্গে নিজের হাত-পাগুলোও একটু সেঁকে নিচ্ছে, এমন সময় ঘর থেকে বাড়ির গিন্নি ডাক দিলেন—“টুকনী!”
ছেলেটা তাড়াতাড়ি হাতের মোজা জোড়া মাটিতে ফেলে দৌড় দিলে, চকা অমনি ছোঁ দিয়ে মোজাটা নিয়ে রিদয়কে দিয়ে বললে—“পরে ফেল উলের জামা।” রিদয় মোজাটা মাথায় গলিয়ে ছেঁড়া মোজার তিনটে ছেঁদা দিয়ে হাত আর মাথা বার করে ফিট হয়ে যেন সোয়েটার পরে দাঁড়াল।
হাঁসের দল তাকে পিঠে নিয়ে আকাশে উঠল—টুকনী ছোঁড়াটা নিচে দাড়িয়ে চেঁচাতে লাগল—“আরে-আরে হাঁস মোজা লেকে ভাগা !”
রিদয় শুনলে গিন্নি চেঁচাচ্ছেন—“হাঁসে কখনো মোজা নেয়? নিশ্চয় মোজাটা পুড়িয়ে রেখে মিছে কথা বলছে! ফের ঝুটবাত বোলতা!”
টুকনীর মোজা-পোড়ানোর মামলার শেষ কি হল দেখবার আর সময় হল না! মেঘ তখন মুষল ধারায় জল ঢালতে আরম্ভ করেছে, হাঁসেরা তাড়াতাড়ি মেঘ ছাড়িয়ে উঠতে চেষ্টা করতে লাগল আর বন-জঙ্গলকে ডেকে বলতে লাগল—“কত জল আর চাই বল, তেষ্টা যে মেটে না দেখি, মেটে না দেখি!” কিন্তু দেখতে-দেখতে আকাশ নীল মেঘে ছেয়ে গেল, সূর্য কোথায় কোনদিকে তার ঠিক নেই, হাঁসেদের ডানার উপরে বিষ্টি ক্রমাগত চাবুকের মতো পড়ছে, ডানার পালক ভিজে তাদের বুকের পালকে পর্যন্ত জল সেঁধিয়েছে, পাহাড়-পর্বত চড়াই-নাবাই গাছ-পালা ঘন কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেছে—দু’হাত আগে নজর চলে না। পাখিদের গান থেমে গেছে। হাঁসেরা চলেছে, ধীরে-ধীরে পথ খুঁজে-খুঁজে; রিদয় কেবলি শীতে কাঁপছে আর ভাবছে, চুরি করার এই শাস্তি।
এই মেঘ আর কুয়াশার মধ্যে দিয়ে চকা-নিকোবর যখন তাদের কটিকে নিয়ে সিংচল পাহাড়ের সিংএ একটা ঝাউতলায় এসে বলল, তখন যেন রিদয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল! পাহাড়ের চূড়োয় কেবল সোনালী ঘাসের বন আর এক-একটা ছাতের মতো প্রকাগু-প্রকাও পাথর বরফ পড়ে শাদা হয়ে রয়েছে—কোথাও-কোথাও নালা দিয়ে বরফ-জল বয়ে চলেছে, পাতায়-পাতায় টিপটপ করে বিষ্টি লাগছে কিন্তু শীত হলেও হাওয়া এখানে এমন পরিষ্কার যে রিদয় আনন্দে এদিকে-ওদিকে ছুটে বেড়াতে লাগল! বুনো টেঁপারি সোনালী পাতা রুপোলী পাতা সোনা-ঘাস রুপো-ঘাস তুলে-তুলে রিদয় বোঝা বাঁধছে দেখে চকা হেসে বললে—“এগুলো হবে কি?”
রিদয় অমনি বলে উঠল—“দেশে গিয়ে দেখাব !”
খোঁড়া হাস ভয় পেয়ে বললে—“ওই মস্ত বোঝা নিয়ে ওড়া আমার কর্ম নয়, তুমি তবে রেলে করে বাড়ি যাও!”
চকা রিদয়কে ডেকে বললে—“খুব-কাজের জিনিস ছাড়া একটি বাজে জিনিস সঙ্গে নেওয়া আমাদের নিয়ম নয়, পেট ভরে টেঁপারি খাও তাতে আপত্তি নেই, ঘাস দু’কানে দুটো গুঁজতে পার তার বেশি নয়!”
রিদয় দু’কানে দুটো ঘাস গুঁজে টেঁপারি খেয়ে বেড়াচ্ছে এমন সময় ভালুকের সঙ্গে দেখা! রিদয় ভালুক নাচ অনেক দেখেছে কিন্তু এত-বড় এমন রোঁয়াওয়ালা কালো মিস ভালুক সে কোনোদিন দেখেনি, ভালুক তাকে দেখে দু’পা তুলে থপথপ করে এগিয়ে এসে বললে—“এখানে মানুষ হয়ে কি করতে এসেছ? পালাও, না হলে শীতে মরে যাবে, বড় খারাপ জায়গা। গোরাগুলো পর্যন্ত এখানে টিঁকতে পারেনি, কত লোক যে এখানে ঠাণ্ডা আর রাতের বেলায় ভূতের ভয়ে কেঁপে মরেছে তার ঠিক নেই। এখানে এককালে গোরা-বারিক ছিল কাণ্ডেল জাঁদরেল সব এখানে থাকত, এখন আর কেউ নেই! কোথায় গেছে তাদের বাগ-বাগিচা বাজার-শহর, কেবল দেখ চারদিকে আগুন-জ্বালাবার চুলোগুলো পড়ে আছে, শীতে সব গোরা ভুত বেরিয়ে এই-সব ভাঙাচুলির ধারে বসে আগুন পোহায় আর মদ খায়, হুক্কা-হুয়া গান গায়।”