সব কাক যে-যার ঘরে গেছে, তখন ঢোঁড়াকাক এসে রিদয়কে বললে—“তুমি জানো না আমার কি উপকার করেছ। এস আমার পিঠে চড়ো আমি তোমাকে এমন জায়গায় রেখে আসব যেখানে শেয়ালের বাবাও আর ধরতে পারবে না।”
এত হুটোপাটির পর রিদয়ের ঘুম পাচ্ছিল, সে কাকের পিঠে চড়ে ঢুলে-ঢুলে পড়তে লাগল! ঘুমের ঘোরে তার যেন মনে হল অন্ধকারে কাকের চেহারাটা গণেশের ইঁদুরের মতো হয়ে যাচ্ছে—কাক বগ হাঁস শেয়াল সব এক সঙ্গে তার মাথার ভিতরে ঘুরছে। এমন সময় আকাশ থেকে যেন বোধ হল চকার দল হাঁকলে—“কোথায়?”
“হেথায়” বলে যেমন রিদয় চেয়েচে অমনি দেখলে কোঁ করে দরজা খুলে গণেশের মতো মোটা পেট নিয়ে তার বাপ ঘরে ঢুকে বললেন—“কিছু ভাঙিসনি তো?”
রিদয় ভয়ে-ভয়ে একবার কুলুঙ্গিটার দিকে চেয়ে দেখলে যেখানকার গণেশ সেইখানেই রয়েছে—দুবার মাথা চুলকে রিদয় এক দৌড়ে বাড়ির উঠোনে এসে দেখলে খোড়াহাঁস পুকুর পাড়ে একটা বুনো হাঁসের সঙ্গে ভাব করছে—আর একটা ঝোড়োকাক চালে বসে “কা-কা” করে ডাকছে—গোয়ালঘর থেকে কপলে গাই ডাকদিলে “ওমঃ”, ঠিক সেই সময় একটা গুগলী পুকুর ঘাট বেয়ে আস্তে-আস্তে জলে নেমে গেল।
রিদয় পুকুর পাড়ে হাঁ করে কি ভাবছে দেখে রিদয়ের মা কাছে এসে বললে—“কি হল তোর?”
রিদয় মাথা চুলকে বললে—“মা, আমি কি সত্যিই বড় হয়ে গেছি?” বলে আপনার মাথায় হাত বুলোতে লাগল!
সেই সময় ডালিমগাছে টুনটুনি পাখি বলে উঠল—“ওকি রিদয় হল কি!”
“মাখা আর মুণ্ডু হল!” বলে রিদয় পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে সাঁতার আরম্ভ করলে।
রিদয়ের মা চেঁচিয়ে বললে—“এত বড়টি হলি তবু তোর ছেলেমানষি গেল না। উঠে আয়, পাঠশালায় যাঃ।”
চকা-নিকোবর
সুবচনীর খোঁড়া হাঁস এই সব বুনো-হাঁসদের দলে ভিড়ে উড়তে, আর এ-গ্রামের সে-গ্রামের সব সরাল, ঘেংরালদের দেখে হাসি-মস্করা করতে পেয়ে, ভারি খুশি হয়েছে। সে ভুলে গেছে যে নিজেই সে এত-কাল পালা-হাঁসই ছিল—ঐ সরাল-ঘেংরালের মতো ঘর আর পুকুর করে কাটিয়েছে। তার উপর সে আজন্ম-খোঁড়া, সবে আজ নূতন উড়ছে। বুনো হাঁসের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে চলা তার কর্ম নয়! খোঁড়ার ডানার তেজ ক্রমেই কমছে আর দমও ক্রমে ফুরিয়ে আসছে, সে হাঁপাতে-হাঁপাতে তাড়াতাড়ি ডানা ঝাপটেও আর পেরে উঠছে না মধ্যে থেকে এক-এক-করে প্রায় আটহাঁস পিছিয়ে পড়েছে। সেথো হাঁসরা যখন দেখলে খোঁড়া পিছিয়ে পড়ে, আর পারে না, তখন পাণ্ডা-হাঁসকে ডাক দিয়ে জানালে—“চকা-নিকোবর, চকা-নিকোবর!”
চকা উড়তে-উড়তেই শুধোলে—“ক্যেঁন্-ক্যেঁন্ কও ক্যেঁন্ ?”
সেথোরা বললে—“পিছিয়ে পোলো খোঁড়া-ঠ্যাং!”
আগের মতো সোঁ-সোঁ করে চলতে-চলতেই চকা বলে উঠল—
জোরে চলায় নাই কোনো দায়,
আস্তে গেলেই হাঁপ লেগে যায়!
অমনি সব হাঁস একসঙ্গে বলে উঠল—“চলে চল, চলে চল, ভাই, চলে চল।”
চকার কথা-মাফিক খোঁড়া হাঁস জোরে চলতে চেষ্টা করতে দুগুণ হাঁপিয়ে পড়ল; আর সে আস্তে-আস্তে ক্রমে মাঠের ধারে-ধারে নারকোল গাছের প্রায় মাথা পর্যন্ত নেমে পড়বার মতো হল। তখন সেথো হাঁসরা আবার ডাক দিলে—“চকা-নিকোবর—চকা-চকা-চকা!”
এবার চকা গরম হয়ে বললে—“ক্যেঁন্ কর ভ্যেঁন ভ্যেঁন?”
সেথোরা বলে উঠল—“খোঁড়া হাঁস তলিয়ে যায়!”
চকা একবার চেয়েও দেখলে না, যেমন বেগে চলেছিল তেমনি পুরো দমে যেতে-যেতে বললে—“বল ওকে হাল্কা হাওয়ায় উঠে আসতে।”
নিচের বাতাস ঠেলা মুশকিল,
ডানা নেড়ে-নেড়ে লাগে ঘাড়ে খিল।
উপর বাতাস পাতলা ভারি,
এক ঝাপটে বিশ হাত মারি।
খোঁড়া হাঁস চকার কথায় উপরে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল; কিন্তু এবার বাতাস ঠেলে উঠতে বেচারার দম নিকলে যাবার যোগাড় হল ।
আবার সেথোরা ডাক দিলে—“চকা! চকা!”
“কেনে ? চলতে দিবে না নাকি!”—বলে চকা গোঁ হয়ে উড়ে চলল।
সেথোরা বললে—“খোঁড়া-বেচারার প্রাণসংশয়!”
চকা রেগে উত্তর দিলে—
উড়তে না পারে ঘরে যাক,
খাক-দাক বসে থাক।
কে বলেছে উড়তে ওরে,
ভিড়তে দলে রঙ্গ করে?
খোঁড়া হাঁসের জানতে বাকি রইল না যে বুনো হাঁসরা কেবল তামাশা দেখবার জন্যে তাকে এতটা সঙ্গে এনেছে—মানস-সরোবরে নিয়ে যেতে নয়। আঃ কি আপশোষ! ডানা যে তার আর চলছে না! না হলে খোঁড়া হাঁসও যে উড়তে পারে, সেটা একবার বুনো হাঁসদের সে দেখিয়ে দিত। তা ছাড়া এই চকা-নিকোবর—এমন হাঁস নেই যে একে জানে না; এই একশো বছরের বুড়ো হাঁস, যার সঙ্গে পয়লানম্বর হাঁসও উড়ে পেরে ওঠে না, পড়বি তো পড় তারি পাল্লায়! যে চকা পোষা হাঁসকে হাঁসের মধ্যেই ধরে না, লজ্জা পেতে হল কিনা তারি সামনে! এ দুঃখু সে রাখবে কোথায়!
খোঁড়া সবার পিছনে ভাবতে-ভাবতে চলল—বাড়ি ফিরবে, কি, প্রাণ যায় তবু সমানে বুনো হাঁসের সঙ্গে চলে সে দেখিয়ে দেবে যে সেও জানে উড়তে! রিদয় এই সময় খোঁড়াকে বললে—“সুবচনীর কৃপায় এতদূর এসেছ, আর কেন ? এইবার ফের। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে গিয়ে শেষে দম-ফেটে মরবে নাকি! আমি তো ওদের মতলব ভালো বুঝছিনে!”
রিদয় কিছু না বললে, হয়তো খোঁড়া আপনা-হতেই বাড়ি-মুখো হত; কিন্তু এই বুড়ো-আংলা, এও ভাবছে তাকে কমজোর! খোঁড়া বিষম রেগে ধমকে উঠল—“ফের কথা কইলে মাটিতে ঝেড়ে-ফেলে চলে যাব।” বলেই রেগে ডানা আপসে খোড়া এমনি তেজে উড়ে চলল যে বুনো হাঁসরাও একেবারে অবাক হয়ে গেল। রাগের মুখে গোঁ-ভরে যেমন তেজে খোঁড়া চলেছিল, রাগ পড়লে সে তেজ থাকত কিনা সন্দেহ। কিন্তু ঠিক সেই সময় সূর্য পাটে বসতে চললেন। দেখতে-দেখতে বেলা পড়ে এল। অমনি হাঁসরা সবাই জমি-মুখো হয়ে ঝুপ-ঝাপ আকাশ থেকে চাঁদপুরের সামনে মেঘনার মাঝে বাগদী চরে নেমে পড়ল। চরে উড়ে বসতেই রিদয় হাঁসের পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ল।