রিদয় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বললে—“তোরা যে আমাকে বড় ধরে আনলি!”
ডোমরাজা দৌড়ে এসে বললে—“চুপ, কথা কবি তো চোখ ঠুকরে নেব!” .
রিদয় বুঝলে এবার সহজে ছাড়ান নেই, এরা সব ডাকাতে-পাখি! গোলযোগ করলে হয়তো মাথাটাই ফাটিয়ে দেবে। সে কি করে, শুকনো মুখে কাকগুলোর দিকে চেয়ে রইল। কাকগুলোও তাকে ঘিরে ধারাল ঠোঁট বাড়িয়ে একচোখে তাগ করে দাঁড়িয়ে থাকল।
দূর থেকে দেখে রিদয় ভাবত কাকগুলো বেশ কালো চিকচিকে, যেন কালো আলপাকার চায়না-কোট পরা নতুন উকিল কৌঁছিলের মতো, চালাক চতুর চটপটে। কিন্তু কাছ থেকে কাকগুলোকে রিদয় দেখলে কদাকার কালো কুচ্ছিত যতদূর হতে হয়, পালকগুলো রুখো মড়মড়ে যেন কালিতে ছুপোনো তালপাতা, পাগুলো গেঁটে-গেঁটে কাদামাখা খরখরে, ঠোঁটের কোণে এঁটো ঝোলঝাল মাখানো; একটা চোখ যেন ছানি পড়া আর একটা যেন ময়লা পয়সার মতো তামাটে কালো! কোথায় শাদা ধপধপে সুবচনীর হাঁস আর কোথায় এই কালো কুচ্ছিত কাগের ছা সব!
রিদয় এই কথা ভাবছে এমন সময় মাথার উপরে অনেক দূর থেকে হাঁসের ডাক এল—“কোথায়—কোথায়?” রিদয় গলা শুনে বুঝলে খোঁড়া তার সন্ধানে চলেছে, সেই সঙ্গে-সঙ্গে বালি হাঁসও ডাক দিয়ে গেল “সেঙাত-সেঙাত!” বনের ওধারটায় বুদিও একবার হাক দিলে—“ওগোঃ ওগোঃ!” রিদয় বুঝলে তিনজনেই এসেছে, সে অমনি হাত নেড়ে হেথায় বলে চেঁচাতে যাবে আর ডোমরাজা ছুটে এসে ধমকে বললে—“কিও! আয় দিই চোখ দুটাে খুবলে!” রিদয় অমনি মুখ বুজে গোঁ হয়ে বসল।
হাঁসেরা চলে গেল বুদি গাইও ডেকে-ডেকে থামল, তখন ডোমকাক হুকুম দিলে—“উঠাও!” দুটো কাক তাকে আবার ঠোঁটে ঝুলিয়ে নিয়ে ওড়বার চেষ্টায় আছে দেখে রিদয় বললে—“বাপু তোমাদের মধ্যে কেউ পালোয়ান কাক থাকে তো আমাকে পিঠে করে নিয়ে চল, অমন ঝোলাখুলি করলে আমার হাত পায়ের জোড় সব খুলে যাবে যে!”
ডোমকাক ধমকে বললে—“চল-চল, অত বাবুগিরিতে কাজ নেই। কাগে চড়বেন এত সুখ তোর কপালে—আমরা কি ঘোড়া যে তোকে পিঠে নেব।”
এবারে ঝোড়োকাগ এগিয়ে এসে বললে—“মহারাজ, মানুষটাকে হাড়গোড় ভেঙ্গে দ করে নিয়ে গেলে তো ওটা আমাদের কোনো কাজে আসবে না, আমি বরং ওকে পিঠে নিই, কি বলেন?”
ডোমকাক মুখ সিঁটকে বললে—“তোমার ইচ্ছে হয় তো ওর পালকি-বেহারার কাজ করতে পার, কিন্তু দেখ পালায় না যেন!”
রিদয় দেখলে ঢোঁড়াকাগটা ওর মধ্যে দেখতে-শুনতে ভদ্দর রকম, সে আস্তে-আস্তে তার পিঠে চড়ে বসল।
কাকের দল ক্রমাগত দক্ষিণ মুখেই উড়ে চলেছে। পরিষ্কার দিনটি খটখট করছে, চারদিকে যেন বাতাস আর আলো ছড়িয়ে পড়েছে, বনের শিয়র দিয়ে রিদয়কে নিয়ে কাকরা উড়ে চলল।
রিদয় দেখলে বৌ-কথা-কও পাখি বকুল গাছের আগডালে বসে বৌকে শুনিয়ে কেবলি গাইছে—“কথা কও বৌ কথা কও, মাথা খাও বৌ কথা কও!” রিদয় অমনি বলে উঠল—“কথা কইবে কি ছলে, কথা শুনলে গা জ্বলে!”
“কে রে?” বলে হলদী পাখি আকাশের দিকে ঘাড় তুলতেই, রিদয় তাকে শুনিয়ে বললে—“কাকে-ধরা যক্! কাকে-ধরা যক্!”
ডোমকাক অমনি ধমকে উঠল—“আবার কথা!”
আরো দক্ষিণ-মুখো গিয়ে রিদয় দেখলে আমবাগানের মাথায় ঘুঘু বসে তার বৌকে গান গেয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছে আর গলা ফুলিয়ে আদর করে ডাকছে—“বুবু ওঠো দেখি মম্।”
রিদয় অমনি বলে উঠল—“আদর দেখ উহুঃ।”
ঘুঘু গলা তুলে বললে—“কে রে কে রে?”
রিদয় তাকেও শুনিয়ে দিলে—“কাকে ধরা যক্!”
এবার ডোমকাক রেগে রিদয়কে ডানার থাপ্পড় দিয়ে বললে—“ফের বকচিস, চুপ!”
ঢোঁড়াকাক বলে উঠল—“বকুক না যত পারে, পাখিগুলো ভাবচে আমরাও ঠাট্টা-তামাশা শিখেছি।”
ডোমকাক আর উচ্চবাচ্য করলে না। রিদয় ঘাঁটিতে-ঘাঁটিতে সব পাখিকে জানিয়ে দিতে-দিতে চলল—তাকে কাকে ধরেছে!
এমনি বন ছাড়িয়ে তারা একটা নগরের উপরে এসে পড়ল। নদীর ধারে মস্ত শিব-মন্দির, তারি চূড়োয় ত্ৰিশূলের ডগায় বসে শালিক তার বৌকে শুনিয়ে রাগরাগিনীতে গলা সাধছে; বৌ তার পঞ্চবটির বাসায় ডিমে তা দিচ্ছে আর কর্তার গান শুনছে—“সা রে গা মা পা—চারটে ডিমে তা, ধা নি সা—দুই জোড়া ছা!”
রিদয় অমনি আকাশ থেকে বলে উঠল—“কাগে খাবে গা!” শালিক “কেও?” বলে মুখ ফেরাতেই রিদয় শুনিয়ে দিলে—“কাগে ধরা যক্।”
যতই দক্ষিণ দিকে এরা এগোতে থাকল ততই বড়-বড় নদী খাল-বিল ক্ষেত মাঠ-ঘাট গ্রাম-নগর দেখা দিতে থাকল। একটা মস্ত বিলের ধারে একটা হাঁস আর একটা হাঁসের সামনে দাঁড়িয়ে কেবলি ঘাড় নাড়ছে আর বলছে, “চেয়ে দেখ্ আমি তোরি চিরদিন আমি তোরি।”
রিদয়ের মনে হল যেন খোঁড়া আর বালি দুজনে কথা কইছে; সে অমনি তাদের শুনিয়ে বলে উঠল—“এসা দিন রহে থোড়ি রহে থোড়ি!”
“কেও—কেও?” বলে হাস মুখ ফেরাতেই রিদয় শুনিয়ে দিলে—“কাগে ধরা যক্!” এমনি যাকে দেখে, তাকেই নিজের খবর শুনিয়ে দিতে-দিতে রিদয় চলেছে!
বেলা দুপুর, কাকের ঝাঁক এক মঠের জমিতে নেবে সড়া পেসাদ খেতে আরম্ভ করলে। রিদয় খেলে কিনা সে দিকে কারু লক্ষ্য নেই। ডোমকাক রিদয়কে আগলে বসে আছে, এমন সময় ঢোঁড়াকাক একটা ডালিম এনে ডোমকাককে বললে—“মহারাজ দুটাে ফল খেতে আজ্ঞে হোক্!” ডালিম ভাঙা কাকের কর্ম নয়, তা ঢোঁড়াকাক জানত—ডোম-রাজা নাক তুলে বললে—“ওই শুকনো ফল আমি খাব, থুঃ!” ঢোঁড়া অমনি সেটা রিদয়ের পায়ের কাছে ফেলে তাড়াতাড়ি রাজার জন্যে যেন ভালো ফল আনতেই যাচ্ছে এইভাবে ছুটে পালাল। রিদয় বুঝলে ঢোঁড়া তার জন্যেই ডালিমটা এনেছে; সে অমনি সেটা দাঁতে চিবিয়ে ছালসুদ্ধ খেয়ে ফেললে।