“এদানি বুড়ি আর দুঃখু করত না, ছেলেদের কথা হলে বলত—‘বুদি এখানে এলে তাদের তো কষ্ট বই আরাম হবে না, তবে কেন আর তাদের ডেকে পাঠাই; এই তো ভাঙাবাড়ি, এখানে জায়গা কোথায় তাদের বসবার শোবার খাবার! ওই বাপ-মা-হারা আমার শিবরাত্রির সলতে ওই ছোট নাতিটি বেঁচে থাক, মরবার সময় তবু মুখে একটু জল দেবার একজন তো রইল—কি বলিস!” কিন্তু এ নাতিও বড় হয়ে যেদিন কুলির সর্দারি করতে বিদেশে গেল সেদিন থেকে বুড়ির আর চোখের জল থামল না। সে দিন-দিন কুঁজো হয়ে পড়ল, হাল-গরু জোত-জমা সমস্ত পাঁচ ভূতে লুঠে পালাল, বুড়ি দেখেও দেখলে না—শেষে এখানে আর কেউ রইল না—এই বুদি আর ওই বুড়ি ছাড়া। বুড়ি খেতে পায় না দেখে আমি একদিন বললুম–‘মাগো, কসায়ের কাছে আমাকে বেচলে তো পয়সা পাও, তা কর না কেন!’ বুড়ি আমার গলা ধরে বললে—‘বুদি সব ছেলে-মেয়ে তোর দুধ খেয়ে মানুষ হল তোকে আমি কি ছাড়তে পারি!’ আহা সেই আমার সেঙাতনী মনিবনী, গিন্নি মা-জননী আজ নিজেই চলে গেল গোঃ, ওমা”—বলে সে অঝোরে কাঁদতে লাগল।
রিদয় অনেকক্ষণ চুপ করে থেকেই বললে—“আহা বুদি, আমতলিতে মাকে আমি এমনি করে ফেলে এসেছি যে!”
বুদি বলে উঠল—“যাও কালই ফিরে যাও, না হলে হয়তো এই বুড়ির মতো ছেলে-ছেলে করে শেষে সেও মরবে। তোমার তো এখনো গিয়ে মাকে দেখবার সময় আছে কিন্তু এই বুড়ির ছেলেরা কি পোড়াকপাল নিয়েই জন্মেছিল, কখনো দেশেও এল না, মা মরে গেল তাকেও দেখতে পেলে না!”
সকাল বেলায় মিউনিসিপালের মুর্দোফরাসগুলো এসে বুড়িকে পোড়াতে নিয়ে গেল, খটাস চলে গেল দিগ্বিজয়ে, নেউল চলে গেল মৃগয়াতে, রিদয় বুড়ির ঘর থেকে তার ছেলেদের নামের চিঠিখানি ডাকে ফেলে দিয়ে বুদিকে মাঠে রেখে খোঁড়ার কাছে ফিরে চলল। পাতি-জলার কাছ বরাবর এসে রিদয় দেখলে খোঁড়া হাঁস সকালে উঠে জলের মাঝে একটা মাটির ঢিপিতে দাঁড়িয়ে ডানা ঝাড়ছে, বালি হাঁস তখনো ঝোপের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। রিদয় সারারাত কিছু খায়নি, হাঁসের কাছে না গিয়ে সে বরাবর বুদিগাইটার পিছনে-পিছনে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল। দু-একটা পাত-বাদামের চেষ্টায় রিদয় একটা শিরিষ গাছের উঁচুডালে কাঠবেরালিদের ঘরে ভিক্ষে করতে চলেছে। মস্ত শিরিষ গাছ, তার সব উপরের ডালে কাঠবেরালিদের খোপ বসতি, ঝোপ বসতি। এমনি এপাড়া-ওপাড়ায় রিদয় “জয় রাম” বলে গান গেয়ে দাঁড়াচ্ছে আর কেউ এসে তাকে দুটো শুকনো ছোলা, কেউ একটা বাদাম, এমনি টুকি-টাকি ভিক্ষে দিচ্ছে। রামের দোহাই দিলে কাঠবেরালিদের ভিক্ষে দিতেই হয়, কিন্তু এক-এক কাঠবেরালি গিন্নি ভারি কিপটে, রিদয়কে দূর থেকে দেখেই বলছে—“ওগো ঘরে কিছু নেই, কর্তা হাটে গেছেন, ওবেলা এস—এখন কিছু হবে না।” রিদয় পাকা ভিখিরী, সহজে ছাড়বে কেন, গান শুরু করলে:
বাসনা করায় মন পাই কুবেরের ধন
সদা করি বিতরণ তুমি যত আশ না
আস নাই আরো চাই ইন্দ্রের ঐশ্বর্য পাই
ক্ষুধা মাত্র সুধা খাই মরি-মরি ফাঁস না
ফাঁসনা কেবল রৈল বাসনা পূরণ নৈল
লাভে হতে লাভ হৈল লোকে মিথ্যা ভাসনা!
কাঠবেরালি গিন্নি এতেও সাড়া দেয় না, রিদয় এবারে হিন্দি গান ধরলে:
ধুম বড়া ধুম কিয়া খানে জোনে নাহি দিয়া
চহুঁয়ার ঘেরলিয়া ফোজ কি গিতাপয়া!
আরে চহুঁয়ার, আরে চহুঁয়ার।
এক থোকা শিরীষ-ফুলের তলায় দাঁড়িয়ে বুড়ো-আংলা পেট বাজিয়ে গাইছে, এমন সময় মনে হল তার কোমরের কাপড় ধরে কে টান দিচ্ছে, রিদয় ফিরে দেখতেই একটা কাক ‘খাও’ বলে তার ঠোঁট আর ডান হাতটা চেপে ধরলে, অমনি আর একটা কাক, তারপর আর একটা আর একটা এসে রিদয়কে ছোঁ দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলল। ডোম-কাকের দল রিদয়কে চোখে-মুখে কিছু দেখতে দিচ্ছে না—“যক-যকা” বলে এর মুখ থেকে ও, তার মুখ থেকে সে, এমনি রিদয়কে ফুটবলের মতো ছুঁড়ে দিতে-দিতে দল বেঁধে গোলমাল করতে-করতে চলছে দেখে বুদি গাই “ওমা-ওমা” করে চেঁচাতে-চেঁচাতে লেজ তুলে ছুটোছুটি করতে লাগল। ইচ্ছেটা কাকগুলোকে শিং দিয়ে গোঁতায়, কিন্তু তারা আকাশে সে বেচারা মাটিতে—বুদি কেবল ধুলো উড়িয়ে মাঠে ছুটোছুটি করতে লাগল!
খোঁড়া হাঁসও আকাশে কাক দেখে—“ক্যা-ক্যা” বলে একবার ডাক দিলে, কিন্তু দেখতে-দেখতে কাকের দল অদৃশ্য হয়ে গেল।
রিদয় চটকা ভেঙে যখন চেয়ে দেখলে, তখন কাকেরা পাতি-জলা পেরিয়ে নাটবাড়ি ছাড়িয়ে কাকচিরের দিকে চলেছে। হাঁসের পিঠে আরামে উড়ে চলা এক, আর কাকের ঠোঁটে ঝুলতে-ঝুলতে চলা অন্য একরকম। রিদয় দেখলে জলা-জমি যেন একখানা ফাটা-ফুটো গালচের উল্টো পিঠের মতে পায়ের তলায় বিছানো রয়েছে, সবুজ লাল কালা কত রকমের যেন সুয়োঁ-ওঠা পশমে বোনা, বাঙলাদেশের পরিষ্কার ছক-কাটা জমির মতো মোটেই নয়, জলগুলো দেখাচ্ছে যেন মাঝে-মাঝে ছোট বড় আয়না ভাঙা।
দেখতে-দেখতে সূর্যি উঠল, আলো পেয়ে মাটি যেন সোনা রুপো আর নানা রঙের উলে-বোনা কাশ্মীরী শালের মতো দেখাতে লাগল। তারপরে জলা পার হয়ে বন-জঙ্গল মাঠ-ঘাটের উপর দিয়ে কাকেরা রিদয়কে নিয়ে উড়ে চলল! কাকেরা তাকে ধরে নিয়ে কোথায় চলেছে, কোথা রইল খোঁড়া হাঁস, কোথায় বা চকার দল, কোথা বুদি, কোথা বালি!
রিদয় ভয় পেয়ে চারদিক চাইছে এমন সময় ডোমকাকে ডাক দিলে—“খবরদার” অমনি সব কাক রিদয়কে নিয়ে জঙ্গলের তলায় নেমে পড়ল। চোরকাঁটার বনে রিদয়কে ঠেলে ফেলে গোটা পঞ্চাশেক কাক সঙিনের মতো ঠোঁট উঠিয়ে তার চারদিকে পাহারা দিতে দাঁড়িয়ে গেল।