বুদি নেউলের দিকে শিং হেলিয়ে বললে—“ইনি?”
“নেউল পুত্তর ইনিও বেরিয়েছেন মৃগয়া করতে।”
খটাসের দিকে চোখ ফিরিয়ে বুদি রিদয়কে শুধালে—“আর ইনি কে?”
“ইনি হচ্ছেন খটাসের পুত্তুর, দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছেন।”
বুদি গোয়ালের দুয়োর ছেড়ে একপাশ হল, তিন বন্ধুতে বাদলার রাতে গোয়ালে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটাবার যোগাড় করতে চলেছেন, বুদিগাই লেজ নেড়ে বললে—“আর জন্মে কত তপিস্যি করেছি, তাই কাঙালিনীর ঘরে রাজপুত্তুর, পাত্তরের পুত্তুর আর কোটালের পুত্তুরের পা পড়ল!” রিদয় খুশি হয়ে বুদির ঘাড়টা একটু চুলকে দিলে, তারপর খড়ের গাদায় শুয়ে তিন বন্ধুতে চোখ বুজলে।
এদিকে বুদিগাই সারাদিন জাব পায়নি, সে পেটের জ্বালায় কেবলি উসখুস করছে—“ওমঃ মাগোঃ, কোথায় গেলে আজ কি আর খাব না? ও ভাই রাজপুত্তর মাচানের উপর থেকে এক বোঝা খড় নামিয়ে দিতে পার, বড় খিদে লেগেছে!”
রিদয় দেখলে চালের বাতায় মস্ত এক বোঝা খড় চাপানো রয়েছে বটে, কিন্তু সেটা টেনে নামানো রিদয়ের সাধ্যি নয়, একটা আঁটি কোনো রকমে টেনে রিদয় বুদির মুখের কাছে ধরে দিলে। গাই খড়গুলো মুখে নিয়ে জাবর কাটতে লাগল।
রিদয়ের একটু তন্দ্রা এসেছে, এমন সময় বুদি আবার বলে উঠল—“ওমা গো, ভাই পাত্তরের পুত্তুর একটুখানি জল এনে দিতে পার?”
নেউল ঘুমের ঘোরে বললে—“এত রাতে জল পাই কোথা!”
বুদি বিনয় করে বললে—“বাইরেই বিষ্টির জল জমা হয়েছে, উঃ বড় তেষ্টা, আমার গলার দড়িটা যদি খুলে দাও তো ওখানে গিয়ে একটু জল খেয়ে বাঁচি!”
নেউল বুদির গলার দড়িটা দাঁতে কেটে দিয়ে বললে—“যাও তবে!”
বুদি দু-পা গিয়ে বললে—“ইস ভারি অন্ধকার, ভাই কোটালের পুত্তুর।”
খটাস আধবোজা চোখ মেলে বললে—“কি?”
বুদি একে রাতকানা তাতে আবার কানে কালা হয়েছে, খটাস কি বললে—শুনতেই পেলে না। আবার ডাকলে—“ও ভাই কোটালের পুত্তুর আমি রাতকানা, যদি গলার দড়িটি ধরে একটুখানি এগিয়ে দিয়ে এস তো ভালো হয়!”
“ভালো বিপদেই পড়া গেল,” বলে খটাস দড়িটা ধরে বুদিগাইকে উঠানের মাঝে টেনে নিয়ে অন্ধকারে দাঁড় করিয়ে সরে পড়ল!
রাত তখন বারোটা, খড়ের গাদায় তিন বন্ধুতে আরামে নিদ্রা যাচ্ছে, এমন সময় বুদিগাই এসে সবার কানে কানে বললে—“বড় বিপদ, বুড়িটা মরে গেছে!”
রিদয় তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললে—“সেকি ! মরলো কেমন করে?”
বুদি নিশ্বেস ফেলে বললে—“দুঃখের কথা কইব কি, এই সন্ধ্যেবেলা সে আমার গলাটি ধরে বলে গেল—“বুদি শুনেছিস এই নাটবাড়ির জলায় রাজা এবার ধান বোনবার হুকুম দিয়েছেন, এতকালে জমি সব আবাদ হবে; আমাদেরও দুঃখু ঘুচবে।’ আমি বললেম—‘মা, তোমার আর দুঃখু ঘুচবে কি, তোমার ছেলেপুলে ক’টাই বিদেশে গিয়ে সংসার ফেঁদে কাজ-কারবার করতে বসে গেল, বুড়ি মাকে তো তারা একটিবার মনেও করলে না!’ মা বললে—‘বুদি লো বুদি, তাদের দুষিসনে, ঘরের ভাত পেলে কি তারা আমাকে একলা ফেলে বিদেশে যায়, না পরের চাকরি করে? এইবার তাদের চিঠি দেব দেখিস কেমন না তারা আসে। আমার মরবার সময় সব ছেলেরা এসে আমায় ঘিরে দাঁড়াবে আর আমি ডঙ্কা মেরে স্বর্গে চলে যাব এই সাধটি আমার কি পূর্ণ হবে বুদি!’ এই বলে মা ঘরের মধ্যে চিঠি লিখতে গেল, গোয়াল-ঘরে আর জাবও দিতে এল না, পিদুমও জ্বাললে না! সন্ধ্যেবেলা মাকে যেন কেমন-কেমন দেখনু, তাই বলি একবার যাই দেখে আসি। ওমা, ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি যেখানকার যেটি সব তেমনি গোছানো রয়েছে—পিদুমটি জ্বলছে বিছানা পাতা রয়েছে কিন্তু মা আমার চিঠিটুকু হাতে নিয়ে আলুথালু হয়ে দরজার ধারে পড়ে রয়েছেন, ছেলেরা আসবে ছেলেরা আসবে করেই বুড়ি মলো গো!”
“আহা! এই গয়লা-বোয়ের দশা কি এমন ছিল। এই বাড়িতে দেখেছি ছেলে-মেয়ে চাকর-বাকর গিসগিস করছে—ঐ নাটবাড়ির সমস্ত জলাটা ওদের জমিতে পড়েছে, আজ এখনো কত জমি যে বেখবর পড়ে আছে তার ঠিক নেই। কর্তা যতদিন ছিলেন যেমন বোলবোলা তেমনি লক্ষিরছিরি। আহা, ওই গয়লা-বৌ তখন দুবেলা সেজেগুজে পাঁচজন গয়লানী সঙ্গে গাই দোহাতে আসত, নূপুরের শব্দ শুনলে গাই-গরু সব চারদিক থেকে হামা দিয়ে ছুটে আসত গো। এমন লক্ষী বৌ কচি-কাচা নিয়ে বিধবা হল গো! তখন এক-একদিন সে আমার গলা ধরে কানতো আর বলত—‘বুদি, আর পারিনে যন্ত্রণা সইতে।’ আমি বলি, ‘মা এই শরীর তোমার, একা সবদিক দেখা কি তোমার কর্ম, দু-চারটে দাস-দাসী নায়েব-গোমস্তা বেশি রাখলে হয় না?’ কিন্তু সে বড় কর্মিষ্টি, নিজের হাতে ছেলে-মানুষ ধান-বোনা রান্না-করা গাই-দোয়া সব করবে! আমি বলি—‘মা, শরীর যে ক্ষেয় হল!’ কিন্তু বৌ কেবলি বলে—‘ভালো দিন আসছে বুদি আসছে!’ আর ভালো দিন! ছেলেগুলো বড় হয়ে চাকরির চেষ্টায় বিভুঁয়ে বিদেশে টো-টো করে ঘুরতে লাগল, কেউ বিদেশ গিয়ে সংসার পাতলে, ছেলেপুলে হল কিন্তু বুড়িকে আর কেউ দেখলে না। জমিজমা গহনা-গাঁটি বেচে ছেলে-মেয়ে নাতি-পুতি এমনি তিনপুরুষ ধরে সবাইকে বিয়ে দিয়ে চাকরি নিয়ে বিদেশে পাঠাতে-পাঠাতে বুড়ি ক্রমে সর্বস্বান্ত হয়ে না খেয়ে মরবার দাখিল হল! ছেলে-মেয়ে কত যে জন্মাল, মানুষ হল, বড় হয়ে বুড়িকে একলা রেখে চলে গেল, এই গয়লাবাড়িতে ক’পুরুষ ধরে কত কারখানাই দেখলুম যে, তা কি বলি!