রিদয় বলে উঠল—“আমারো তো দেশ আছে কিন্তু আমার তো সেখানে ফিরতে একটুও ইচ্ছে হয় না।”
চকা বললে—“সে কি! তোমার বাপ-মা কেউ নেই নাকি? যখন বড় হবে, বৌ হবে সংসার হবে, ছেলে-পুলে নাতি-পুতি হবে তখন বুঝবে সারা বছরের পরে দেশে ফিরতে কি আনন্দ। তখন দেশের ডাক যখন এসে পৌঁছবে তখন দেখবে মন অমনি উধাও হয়ে ছুটেছে আর কিছুতে মন বসছে না, প্রাণ নীল আকাশে প্রজাপতির মতো সোনার পাখনা মেলে দিয়ে উড়ে পড়তে চাচ্ছে, তখন দেশের কথাই কইতে থাকবে। এর সঙ্গে তার সঙ্গে, দিন নেই রাত নেই কি সকাল কি সন্ধ্যে কেবল বঁধুর মুখ মধুর হাসিই মনে জাগবে তখন।”
চকার কথা শুনতে-শুনতে রিদয় কেমন আনমনা হয়ে গেল। সারাদিন ধরে আজ তার কেবলি মনে পড়তে লাগল—আমতলির সেই ঘর ক’খানি, সেই তেঁতুলতলার ঘাট, তেপান্তর মাঠ, হাঁস-পুকুরের কাদা জল, তাতে শালুক ফুল, বাড়ির ধারে ঝুমকো-লতার মাচা তার উপরে দুগ্গা টুনটুনি পাখিটি, উঠোনের কোণে তুলসীমঞ্চটি, কালো মাটি-লেপা ঘরের দেওয়াল তার উপরে মায়ের হাতে লেখা লক্ষ্মীপুজোর আলপনা, দড়ির আলনায় বাপের কোঁচানো চাদর, পুরোনো শোবার তক্তা তার উপরে শীতলপাটি আর লাল ঝালর দেওয়া তালপাতার পাখাখানি। সব আজ পরিষ্কার যেন রিদয় চোখে দেখতে লাগল, আর থেকে-থেকে মন তার ঘরে যেতে আকুলি-বিকুলি করতে থাকল—সকাল কেটে দুপুর হয়েছে, তখনো রিদয় আকাশের দিকে চেয়ে ঘরের কথা ভাবছে—দলে-দলে কত পাখির ঝাঁক দেশমুখে চলে গেল—“চল-চল চলরে চল” বলতে-বলতে। নাটবাড়ির জলায় যত পাখি—
কাদাখোঁচা জলপিপি কামি কোড়া কঙ্ক
পালতির কুঁচেবক আর মৎস্য বঙ্ক।
ডাহুকা ডাহুকি আর খঞ্জনী খঞ্জন
সারস সারসী যত বক বকীগণ।
তিত্তির তিত্তরা পানিকাক পানিকাকি
কুরবী কুরল চক্রবাক চক্রবাকি।
সবাই দলে দলে দেশমুখে উড়ে পড়ছে! রিদয় দেখলে মাথার উপর দিয়ে কত পাখির ঝাঁক দেশ-বিদেশ থেকে, কেউ বন ছেড়ে, কেউ খাঁচা ভেঙে হুহু করে দেশে চলেছে—
ময়না শালিকা টিয়া তোতা কাকাতুয়া
চাতক চকোর নুরী তুরী রাঙ্গচুয়া।
ময়ূর ময়ূরী সারিশুক আদি খগ
কোকিল কোকিলা আদি মরাল বিহগ।
সীকরী বহরী বাসা বাজ তুরমুতী
কাহা-কুহি লগড় ঝগড় জোড়া ধুতি।
শকুনী গৃধিনী হাড়গিলা মেটেচিল
শঙ্খচিল নীলকণ্ঠ শ্বেত রক্ত নীল।
ঠেটি ভেটি ভাটা হরিতাল গুড়-গুড়—
বাকচা হারিত পারাবৎ পাকরাল
হাতারিয়া করকটে ফিঙ্গা দহিয়াল।
চড়ুই মুনিয়া পাবদুয়া টুনটুনি বুলবুল ফুলঝুটি ভিংরাজ রঙে-রঙে সবুজে-লালে সোনালীতে-রূপোলীতে আকাশ রাঙিয়ে চলেছে যে যার দেশে বাতাসে ডানা ছড়িয়ে। রিদয় কেবলি বসে-বসে দেখতে লাগল আর মনে-মনে বলতে লাগল—“যদি ডানা পেতুম!”
পাখিদের দেখাদেখি ভীমরুল ডাঁশ মশা দলে-দলে উড়তে আরম্ভ করেছে, চকার দলের হাঁসেরা আর স্থির থাকতে পারছে না, এখনো সারারাত এখানে কাটাতে হবে ভেবে তারা কেবলি উসু-খুসু করছে আর ডানা ঝাড়া দিচ্ছে!
চকা একবার রিদয়ের কানের কাছে বলে গেল, যা কিছু নেবার আছে সঙ্গে, এইবেলা বেঁধে-ছেদে রাখ, কাল ভোরেই রওনা হতে হবে। রিদয়ের দেশের জন্যে মনটা আনচান করছে কিন্তু বেড়াবার শখ এখনো মেটেনি। সে পথের মাঝে নিজের আর খোঁড়ার জন্যে গোটাকতক গুগলী টোপাপানা এটা-ওটা সেটা নিয়ে উলুখড়ের একটি গেঁজে বুনতে বসে গেল।
থলেটা তৈরি হতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এল। হাঁসেরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চোখ বুজে রাতটা কোনো রকমে কাটিয়ে দেবার যোগাড় করছে এমন সময় চকা এসে রিদয়কে শুধালো—“খোঁড়াকে দেখেছ কি ? তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
রিদয় তাড়াতাড়ি থলে ফেলে উঠে দাড়িয়ে বললে—“সে কি, গেল কোথায়, শেয়ালে নিলে না তো?”
চকা শুকনো মুখে বললে—“এই তো এখানে একটু আগেই ছিল, হঠাৎ গেল কোথা !”
রিদয় বিষম ভয় পেয়ে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি খোঁজাখুজি করতে লাগল। একে সন্ধ্যা হয়ে গেল, যেখানে পাখির ডাক শোনে সেইদিকেই রিদয় ছুটে যায়, ঝোপ-ঝাড় নেড়ে দেখে, নাম ধরে ডাক দেয়, এমনি সারারাত রিদয় ছুটোছুটি করতে লাগল অন্ধকারে জল কাদা ভেঙে! নাটবাড়ির উঠোনটা পর্যন্ত রিদয় খুঁজে এল, কিন্তু সুবচনীর খোঁড়া হাঁস কোথাও নেই!
এদিকে সকাল হয়ে এল, চকা বললে—“সে নিশ্চয়ই অন্য দলে মিশে এগিয়ে গেছে, আর মিছে খোঁজা, চল আমরা বেরিয়ে পড়ি, সময় উৎরে যাচ্ছে!”
রিদয় ঘাড় নেড়ে বললে—“তাকে না নিয়ে আমি এখান থেকে নড়ছিনে, তোমরা যেতে চাও যাও।”
চকা মুশকিলে পড়ল! রিদয় নড়তে চায় না, এদিকে সব হাঁসেরই দেশে যাবার টান রয়েছে, তবু খোঁড়ার জন্যে চকা আরো এক ঘণ্টা দেরি করলে, তাতেও যখন খোঁড়ার সন্ধান পাওয়া গেল না তখন তারা রিদয়কে একলা রেখে চট করে দেশ থেকে ঘুরে আসবার জন্যে উত্তরমুখে উড়ে পড়ল—আসি-আসি বলতে-বলতে।
চকার দল চলে যেতে রিদয়ের চারদিক যেন শূন্য বোধ হতে লাগল! সে আস্তে-আস্তে নাটবাড়ির ভাঙা পাঁচিলটা আর একবার সন্ধান করতে চলেছে, এমন সময় দূর থেকে দেখলে খোঁড়া কিরাশ-কলমীর ডাঁটা মুখে নিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে পাঁচিলের গায়ে একরাশ ভাঙাচোরা পাথরের মধ্যে গিয়ে সেঁধোলে। এমনি খোঁড়াকে শেওলাগুলি নিয়ে সেখানটায় আনাগোনা করতে দেখে রিদয় লুকিয়ে-লুকিয়ে পাঁচিলে উঠে দেখলে—জড়োকরা পাথরের মধ্যে চমৎকার ছাই রঙের একটি বালিহাঁস শুয়ে আছে, খোঁড়া তার মুখে খাবার তুলে-তুলে দিচ্ছে আর দুজনে কথা হচ্ছে—“আজ কেমন আছ? তেমনিই? ডানার বেথাটা যায়নি?”