রিদয়ের মনে হচ্ছে এইবার সিঁড়ি শেষ হল কিন্তু খানিক গিয়ে আবার সিঁড়ি, আবার চাতাল, আবার ধাপ, আবার দেওয়াল, এমনি ক্রমাগত ওঠানামা করতে-করতে চলা—এর যেন আর শেষ নেই। আঁধি ধাদি ভূত পেত্নি ব্রহ্মদৈত্য ঝাম ঝামড়ি কন্ধকাটা শাঁকচুন্নি ডাকিনী যোগিনী ভ্যাল ভেলকি, পেটকামড়ি সবই আজ ভূতচতুর্দশীতে জটলা করতে বেরিয়েছে, আঁদাড়ে-পাঁদাড়ে রিদয়কে দেখে কেউ ঝমঝম করে নাচতে লাগল, কেউ ফিকফিক করে হাসতে লাগল। খুল-খাস খিট-খাট আওয়াজ করে ভূতেরা কেউ খড়ম পায়ে, কেউ হাড় মড়-মড় করে, কেউ বা ঘণ্টা বাজিয়ে, কেউবা চটি চটপট করে তার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। ভয়ে রিদয়ের হাত-পা অবশ হয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময় সরু গলির শেষে মস্ত একটা চাতালের উপরে এসে পেঁচা “ঠাকুরবাড়ি” বলেই অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল!
অনেকক্ষণ ধরে কারুর সাড়াশব্দ নেই, রিদয় অন্ধকারে হাতড়ে দেখলে চারদিকে দেওয়াল, দরজাও নেই, কিছুই নেই! রিদয় ভয়ে কাঠ হয়ে দাড়িয়ে আছে, একটা কে তার পায়ে এসে সুড়সুড়ি দিয়ে তাকে আস্তে-আস্তে দেওয়ালের কাছে টেনে নিয়ে গেল, তারপর কিচ করে যেন চাবি খোলার শব্দ হল! একটা মস্ত দরজা হড়হড় করে গড়িয়ে আপনি যেন খুলে যাচ্ছে, পায়ের নিচে পাথরের মেঝেটা তারি ভারে কাঁপছে!
ঠিক সেই সময় বিকট শব্দে মাথার উপরে ঘটং-ঘং ঘটং-ঘং করে রাত বারোটার ঘড়ি পড়ল। অমনি দপ-দপ করে চারদিকে আলোয়-আলো এসে দেওয়ালীর পিদুম জালিয়ে দিলে, আর ঘণ্টা নাড়তে-নাড়তে ভয়ঙ্কর এক কাপালিক ব্রহ্মদৈত্য মড়ার মাথার খুলিতে ঘিয়ের সলতে জ্বালিয়ে উপস্থিত—
গলে দোলে ভীষণ রুদ্রাক্ষ মালা
পিঙ্গল নয়নে যেন মহেশের কোপানল জালা!
রিদয় দেখলে ঘরের মধ্যে কালো পাথরের প্রকাণ্ড এক মূর্তি, তাতে কতকালের রক্ত চন্দনের ছিটে, ভৈরবটির জিব লকলক করছে আর গায়ে সোনা-রুপো হীরে-জহরৎ আর মুণ্ডুমালা ঝুলছে! ব্রহ্মদৈত্য আরতি আরম্ভ করলেন:
রম্-ঝম্ রম্ ঝম্ শব্দ উঠে
ভূত প্রেত পিশাচ দাঁড়ায় সবে জোড় করপুটে।
তাধিয়া-তাধিয়া বাজায় তাল
তাতা থেই-থেই বলে বেতাল
ববম-ববম বাজায়ে গাল
ডিমি-ডিমি বাজে ডমরু ভাল
ভবম-ভবম বাজায়ে শিঙ্গা
মৃদঙ্গ বাজায় তাধিঙ্গা ধিঙ্গা
ধেই-ধেই নাচে পিশাচ দানা।
রিদয় হাঁ করে ভূতের কাণ্ড দেখছে এমন সময় পেঁচা কানের কাছে ফিসফিস করে বললে, “এখানে নয়, পাশের কুঠরীতে গণেশ ঠাকুরের সভা।” হোমের ধোঁয়ায় আলোগুলো ক্রমে ঘোলাটে হয়ে এল; সেই সময় রিদয় পেঁচার সঙ্গে আস্তে-আস্তে পাশ কাটিয়ে গণেশ মহালের গলিতে সেঁধোল। দেউড়িতে একটা মোটাপেট হিন্দুস্থানী দরোয়ান সিদ্ধি খেয়ে খালি গায়ে ভোঁ হয়ে ঢোলক পিটছে, অন্ধকারে রিদয় তাকেই গণেশ ভেবে ঢিপ করে একটা পেন্নাম দিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়াল।
দরোয়ানজী ভারি গলায় বললে, “কৌন হোঃ?”
রিদয় কিছুই বুঝলে না, তবু ঘাড় নেড়ে বললে—“আজ্ঞে আমি রিদয়, নেংটি ইঁদুরেরা বড় বিপদে পড়েছে তাই—“
“ক্যা বক্-বক্ লাগায়া”—বলে দরোয়ান আবার ঢোল পিটতে লাগল।
রিদয় ভাবলে গণেশ বকের কথা শুধোচ্ছেন; সে তাড়াতাড়ি বললে— “আজ্ঞে বকের সঙ্গে আমার আলাপ আছে, কিন্তু আজ আমি ইঁদুরদের হয়ে লড়াই করতে চাই, সেইজন্যে আপনার ঐ জয় ঢাকটি আমি চাই।” বলে রিদয় যেমন ঢোলকে হাত দিয়েছে, অমনি গণেশের দরোয়ান ধমকে উঠল—“ধেৎ তেরি!”
রিদয় ভয়ে দশহাত পিছিয়ে পড়ল—সেই সময় পেঁচা এসে তার কানে-কানে বললেন—“করছ কি? উনি গণেশ নন, ভিতরে চল!” তারপর দরোয়ানের সঙ্গে পেঁচা গিয়ে কি খানিক বকাবকি করলে, তখন দরোয়ান দুয়োর ছেড়ে দিয়ে বললে—“আইয়ে বাবু!”
মহলের মধ্যে গণেশের পরিচয় চৌষষ্টি ভাগ কলাবৌ, কেউ রঙ-তুলি নিয়ে আলপনা দিচ্ছিল, কেউ সেতার বাজিয়ে গান-বাজনা করছিল, কেউ মালা গাঁথছিল, কাঁথা বুনছিল, এমনি চৌষষ্টি খাম্বা ঘরের মধ্যে সবাই এক-এক কাজে, হঠাৎ রিদয়কে দেখে সবাই মাথায় ঘোমটা টেনে জুজুবুড়িটি হয়ে বসল।
পেঁচা সেখান থেকে রিদয়কে নিয়ে আর একটা হাতিশুঁড়ো গজদন্তের খিলেনের মধ্যে দিয়ে গণপতি গণেশের বৈঠকখানায় এনে হাজির করে দিলে। রিদয় দেখলে ঘরের উত্তর গায়ে মস্ত একটা তক্তাপোষে গের্দা হেলান দিয়ে থান ধুতি পরে মেরজাই পরে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, তার গজদাঁতও নেই শুঁড়ও নেই, মোটা পেটও নয়, দিব্যি দেবতার মতো চেহারা!
পেঁচা রিদয়ের কানে-কানে বললে—“ইনিই রাজা গণেশ, এঁকে যা দরবার করতে হয় কর।”
রিদয়ের মুখে কথা নেই, ইনিই গণেশ! ভয়ে-ভয়ে সে এগিয়ে বললে—“মশায়ের নাম?”
উত্তর হল—“আমি গণপতি, কি চাই?”
রিদয় খুব নরম হয়ে বললে—“যে ইঁদুরগুলিতে চড়ে মশায় বেড়িয়ে বেড়ান সেগুলির বড় বিপদ উপস্থিত!”
গণেশ ভুরু কুঁচকে বললেন—“ইঁদুর! আমি তো কোনো দিন ইঁদুরে চড়িনে!”
রিদয় বললে—“আজ্ঞে, ভুলে যাচ্ছেন আপনি, হস্তী-বেশ ধরে যখন হাওয়া খেতে বেরোন, সেই সময় যে ইঁদুর আপনার গাড়ি—”
গণেশ হোঃ-হোঃ করে হেসে বললেন—“তুমি পাগল নাকি আমাকে শুদ্ধ গাড়ি টেনে চলতে পারে যে ইঁদুর তাকে তুমি কোথায় দেখলে? ছেলেবেলায় আমি দু-একটা ইঁদুর পুষেছিলেম কিন্তু সবগুলোর বাচ্চা হয়ে আমার ঘরে এমনি উৎপাত লাগালে যে, সব ক’টাকে আমি ইঁদুর-কলে ধরে বিদায় করেছি। তুমি ভুল খবর শুনেছ, ইঁদুরে আমি চড়িনে, হস্তীবেশেও সঙ সেজে আমি হাওয়া খেতে যাইনে, নিশ্চয়ই কেউ তোমায় ঠকিয়েছে!”