ভালো লাগত আমার দুজনকেই। তাই তাদের কথা এখনও মনে পড়ে। সেই আমাকে মানুষ করা পদ্মদাসীর শেষ কি হল শোনো। একদিন সকালে দাঁড়িয়ে আছি তেতলার সিড়ির রেলিং ধরে; সিঁড়ি বেয়ে তখনও নামতে পারিনে দোতলায়। আমি দাঁড়িয়ে দেখছি তো দেখছিই। মস্ত বড় সিঁড়ির ধাপ ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে অন্ধকার পাতালের দিকে। এমন সময়ে শুনি লেগেছে ঝুটােপুটি ঝগড়া পদ্মদাসীতে আর মা’র রসদাসীতে দোতলার সিঁড়ির চাতালে। এই হতে হতে দেখি রসদাসী আমার পদ্মদাসীর চুলের মুঠি ধরে দিলে দেয়ালে মাথাটা ঠুকে। ফটাস করে একটা শব্দ শুনলুম। তার পরেই দেখি পদ্মাসীর মাথা মুখ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। এই দেখেই আমার চিৎকার, ‘আমার দাসীকে মেরে ফেললে, মেরে ফেললে।’ পদ্মদাসী আমার কান্না শুনে মুখ তুলে তাকালে। আলুথালু চুল, রক্তমুখী চেহারা, চোখ দুটাে কড়ির মতে সাদা। তার পর কি হল মনে নেই। খানিক পরে পদ্মদাসী এল, মাথায় পটি বাঁধা। আমায় কোলে নিয়ে দুধ খাইয়ে দিয়ে চলে গেল। সেই যে আমার কাছ থেকে গেল আর এল না। শুনলুম দেশে গেছে।
তখন গরমি কালটা অনেকেই গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িতে গিয়ে কাটাতেন। কোন্নগরের বাগানে বাবামশায় যাবেন, ঠিক হল। মা পিসিমা সবাই যাবেন; সঙ্গে যাব আমি আর সমরদা। দাদা থাকবেন বাড়িতে; বড় হয়েছেন, স্কুলে যান রোজ, বাগানে গেলে পড়াশুনোর ক্ষতি হবে। আমার আনন্দ দেখে কে। কাল সকালবেলায় যাব, কিন্তু রাত পোহায় না। ঘুমোব কি! সারারাত ধরে ভাবছি, কখন ভোর হয়।
বাবামশায় ওঠেন রোজ ভোর চারটের সময়ে। উঠে হাতমুখ ধুয়ে সিঁড়ির উপরে ঘড়ির ঘরে বসে কালীসিংহের মহাভারত পড়েন, সঙ্গে থাকেন ঈশ্বরবাবু। ওই একটি সময়ে আমরা বাবামশায়ের কাছে যেতে পেতুম। চাকররা আমাদের ভোর না হতে তুলে হাতমুখ ধুইয়ে নিয়ে আসত বাবামশায়ের কাছে। তিনি পড়তেন, আমাদের শুনতে হত। এই গল্প শোনা দিয়ে শিক্ষা শুরু করেছি তখন। কোনো-কোনোদিন ভালো লাগে গল্প শুনতে, কোনোদিন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। মাঝে মাঝে বাবামশায় খানিকটা পড়ে সমরদাকে পড়তে দেন। বলেন, ‘নাও, এবার তুমি পড়ো।’ সমরদা সেই মস্ত মোটা মহাভারতের বই হাতে নিয়ে বেশ গড় গড় করে পড়ে যান। আমাকে কিন্তু বাবামশায় কোনোদিন বলতেন না পড়তে। বললে কি মুশকিলেই পড়তুম তখন বলো তো! এখন কোন্নগরে তো যাওয়া হবে—কত দেরি করেছিল সেদিন সকালটা আসতে। যেমন রামলাল ডাকা ‘ওঠো’, অমনি তড়িঘড়ি বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে ইজের কামিজ বদলে তৈরি হয়ে নিলুম। লোকজন আগেই চলে গেছে বাগানে। এবার আমরা যাব। সাদা জুড়িঘোড়া জোতা মস্ত ফিটন দাঁড়াল দেউড়িতে ভোর পাঁচটায়। আমরা উঠলুম তাতে।
বাবামশায় বসলেন পিছনের সিটে, আমাদের বসিয়ে দিলেন সামনেরটায়। দুপাশে বসলেন আরও দুজন, পাছে আমরা পড়ে যাই। সেকালের গাড়িগুলির দু-পাশ থাকত খোলা—একটুতেই পড়ে যাবার সম্ভাবনা। মা পিসিমা আগেই রওনা হয়েছেন বন্ধ আপিসগাড়িতে। আমাদের ফিটনের পিছনে দুই দুই সহিস হাঁকছে পঁইস, পঁইস; ঘোড়া পা ফেলছে টগ্বগ্ টগ্বগ্। গাড়ি চলতে লাগল জোড়াসাঁকোর গলির মোড়ে শিবমন্দির পেরিয়ে। বড় রাস্তার তেলের আলোগুলি তখনও জ্বলছে, চারদিক আবছা অন্ধকার। ঘুমন্ত শহরের মধ্যে দিয়ে গঙ্গার উপরে হাওড়ার পুলের মুখে এলুম। দূর থেকে দেখি পুলের উপরে উঁচু দুটো প্রকাণ্ড লোহার চাকা, তার আদ্ধেক দেখা যাচ্ছে। হাওড়ার পুল দেখি সেই প্রথম, আমি তো ভয়ে মরি। ওই চাকা দুটোর উপর দিয়েই গাড়ি যাবে নাকি? যদি গাড়ি পড়ে যায় গড়িয়ে গঙ্গায়? যতই গাড়ি এগোয় ততই ভয়ে দু-হাতে গাড়ির গদি শক্ত করে ধরে আঁটসাঁট হয়ে বসি, শেষে দেখি গাড়ি ওই চাকা দুটোর মাঝখান দিয়ে চলে গেল। চাকা দুটোর মাঝখানে যে অমনি সোজা রাস্ত আছে গাড়ি যাবার, তা ভাবতেই পারিনি আমি তখন। হাওড়ার পুলের অপর মুখে টোলঘর পেরিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলুম, বড় বড় গাছের নিচে দিয়ে, গাঁয়ের ভিতর দিয়ে—গাঁগুলি তখনো জাগেনি ভালো করে, মাকড়শার জালের মতো ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার মাঝ দিয়ে চলেছি আমরা। কখনও বা থেকে থেকে দেখা যায় গঙ্গার একটুখানি; ভাবি, এই বুঝি এসে গেলুম বাগানে। আবার বাঁক ঘুরতেই গঙ্গা ঢাকা পড়ে গাছের ঝোপে। শালকের কাছাকাছি এসে কি সুন্দর পোড়া মাটির গন্ধ পেলুম। এখনও মনে পড়ে কি ভালো লেগেছিল সেই সোঁদা গন্ধ। সেদিন গেলুম ওই রাস্তা দিয়েই বালিতে; কিন্তু সেই চমৎকার পল্লীগ্রামের সৌগন্ধ্য পেলুম না। সেই শালকে চিনতেই পারলুম না। শহর যেন পাড়াগাঁকে চেপে মেরেছে। আশেপাশে গলিঘুঁজি, নর্দমা। মাঝরাস্তায় ঘোড়া বদল করে আবার অনেকক্ষণ ধরে চলতে চলতে পৌঁছলুম সবাই কোন্নগরের বাগানে। তখন মোটরগাড়ি ছিল না যে এক ঘণ্টায় পৌছে দেবে শহর থেকে বাগানে। সে ভালো ছিল, ধীরে ধীরে কত কি দেখতে দেখতে যেতুম। গাঁয়ের মেয়েরা পুকুরঘাটে গা ধুতে নেমেছে, পাঠশালায় চলেছে ছেলেরা সরু সরু লাল রাস্তা বেয়ে, মাঝে মাঝে এক-একখানা হাটুরে গাড়ি চলে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি বাঁচিয়ে শহরের দিকে। কোনো এক বুড়োমানুষ ঘরের দাওয়ায় উবু হয়ে হুঁকো টানছে। মুদির দোকানে মুদি ঝাঁপ তুলছে। বাঁশঝাড়ে সকালের আলো ঝিলমিল করছে; একটি দুটি দাঁড়কাক ডাকছে সেখানে। রথতলার রথটা খাড়া রয়েছে। এমনি কত কি সুন্দর সুন্দর দৃশ্য! হঠাৎ দেখা দিল ধানখেতের প্রকাণ্ড সবুজ, তার পরই কোতরঙের ইঁটখোলা—সেখানে পাহাড়ের মতো ইঁটের পাজায় আগুন ধরিয়েছে, তা থেকে ধোঁয়া উঠছে আস্তে আস্তে আকাশে। তার পরই কোন্নগরের বাগান আমাদের। দু-থাক ঢালুর উপরে সাদা ছোট্ট বাড়িখানি। উত্তর দিকে মস্ত ছাতার মতো নিচু একটি কাঁঠালগাছ। বাগানবাড়ির সামনে দাড়িয়ে বুড়ো চাটুজ্জেমশাই—সাদা লম্বা পাকা দাড়ি, মাথায় ঝুঁটি বাঁধা, হাতে একটি গেটেবাঁশের লাঠি, ধবধবে গায়ের রঙ, যেন মুনিঋষি। আমাদের কোলে করে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলেন।