সেই যেবার মুকুলের স্কুলে রবিকার ছবির এক্জিবিশন হয়, আমি দেখতে গছি ; অমিয় বললে, “আমায় গুরুদেবের ছবি বুঝিয়ে দিন।’ বললুম, দেখে বাপু, খুড়ো-ভাইপোর কথা কাগজে যদি বের না করো তবে এসো আমার সঙ্গে।’ তাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি দেখাতে লাগলুম। তা ওইখানেই একটি ছবি দেখি; ছোট্ট ছবিখানা, কলম দিয়ে আঁকা; একটি ছেলে, পিছনে অনেকগুলো লাইনের আঁচড়। ছেলেটি লাইনের জালে আর জঙ্গলে আটকে পড়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বললুম অমিয়কে, ‘দেখো, এ কি আর সবাই বুঝতে পারে?’ পরীস্থানে ঢুকলে আমার অবস্থা হত ঠিক তেমনি। এখন যখন দেখি ছোট ছেলেরা এসে আমার পুতুলের ঘরে কাচমোড়া আলমারির সামনে ঘুরঘুর করে, মনে পড়ে আমিও একদিন প্রায় এদেরই বয়েসে আমার পরীরাজত্বের দুয়োরে এমনিভাবে দাঁড়িয়ে থাকতুম।—ও অভিজিৎ, রঙ-টঙ নিয়ে অত ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না,—বিপদ আছে। এই রঙ-করা নিয়ে আমার ছেলেবেলায় কি কাণ্ড হয়েছে জানো না তো?
আমাদের দোতলার বারান্দায় একটা জলভরতি বড় টবে থাকে কতকগুলো লাল মাছ, বাবামশায়ের বড় শখের সেগুলো। রোজ সেই টবে ভিস্তি দিয়ে পরিষ্কার জল ভরতি করা হয়। একদিন দুপুরে লাল মাছ দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার খেয়াল হল, লাল মাছ, তার জল লাল হওয়া দরকার। যেমন মনে হওয়া কোত্থেকে খানিকটে মেজেণ্ট না কি রঙ জোগাড় করে এনে দিলুম সেই মাছের টবে গুলে। দেখতে দেখতে আমার মতলব সিদ্ধি। লাল জলে লাল মাছ কিলবিল করতে থাকল। দেখে অন্য খেলা খেলতে চলে গেলাম। বিকেলে শুনি। মালীর চিৎকার। জলে লাল রঙ গুললে কে? মাছ যে মরে ভেসে উঠেছে। বাবামশাই বললেন, ‘কার এই কাজ?’ সারদা পিসেমশায় বলে উঠলেন, ‘এ আর কারো কাজ নয়, ঠিক ওই বোম্বেটের কাজ।’ বোম্বেটে কথাটি চীনে গিয়ে সারদা পিসেমশায় শিখে এসেছিলেন। চীনের খেতাব সেইবারই প্রথম পেলুম; তার পর থেকে সবার কাছে ওই নামেই বিখ্যাত হলুম। রঙ গুলে আমি ওইরূপ খেতাব পেয়েছিলেম। অভিজিৎ, বুঝে-শুনে আমার রঙের বাক্সে হাত দিও। না হলে খেতাব পেয়ে যাবে।
আঃ হাঃ, আবার আমার পুতুল গড়বার হাতুড়ি বাটালি নিয়ে টানাটানি কর কেন? স্থির হও, শোনো, আর একটা মজার কথা। ছেলেবেলায় তোমার বয়সে মিস্ত্রি হবার চেষ্টা করেছিলুম একবার। বাবামশায়ের পাখির খাঁচা তৈরি হচ্ছে। খাঁচা তো নয়, যেন মন্দির। বারান্দা জুড়ে সেই খাঁচা, ভিতরে নানারকম গাছ, পাখিদের ওড়বার যথেষ্ট জায়গা, জলখাবার সুন্দর ব্যবস্থা, সব আছে তাতে। চীনে মিস্ত্রিরা লেগে গেছে কাজে; নানারকম কারুকাজ হচ্ছে কাঠের গায়ে। সারাদিন কাজ করে তারা টুকটাক টুকটাক হাতুড়ি বাটালি চালিয়ে দুপুরে খানিকক্ষণের জন্যে টিফিন খেতে যায়; আবার এসে কাজে লাগে। আমি দেখি, শখ যায় অমনি করে বাটালি চালাতে। একদিন, মিস্ত্রিরা যেমন রোজ যায়, তেমনি খেতে গেছে বাইরে, এই ফাঁকে আমি বসে হাতুড়ি বাটালি নিয়ে যেই না মেরেছি কাঠের উপর এক ঠেলা, এই দেখো সেই দাগ, বাটালি একেবারে বাঁ হাতের বুড়ে আঙুলের মাঝ দিয়ে চলে গেল অনেকটা অবধি। তখনি আমি বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে দে ছুট সেখান থেকে। মিস্ত্রিরা এসে কাজ করতে যাবে দেখে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত সে জায়গায় ছড়ানো। কি ব্যাপার, কে কি কাটল? জানা কথা, বোম্বেটে ছাড়া এ আর কারোর কাজ নয়। বাবামশায় ডেকে বললেন, ‘দেখি তোর আঙুল।’ আমি তো ভয়ে জড়োসড়ো, না জানি আজ কি ঘটে যায় আমার কপালে।
কতরকম দুষ্টবুদ্ধিই জগত তখন মাথায়। বাবামশায়ের আছে পোষা ক্যানারি, খাঁচাভরা। শখ গেল তাদের ছেড়ে দিয়ে দেখতে হবে কেমন করে ওড়ে। টুনিসাহেব, এক ফিরিঙ্গি ছোঁড়া, আসে প্রায়ই বাবামশায়ের কাছে শ্রীরামপুর থেকে। পাখির শখ ছিল তার। মাঝে মাঝে সুবিধেমতে দুয়েকটি দামী পাখিও সরায়। সেই সাহেব একদিন এসেছে; তাকে ধরে পড়লুম, ‘দাও না ক্যানারি পাখির খাঁচা খুলে। বেশ উড়বে পাখিগুলো। জাল আছে এখানে, আবার ওদের ধরা যাবে।’ অনেক বলাকওয়ার পর সাহেব তো দিলে খাঁচার দরজা খুলে। ফুর্ ফুর্ করে পাখিগুলো সব বেরিয়ে পড়ল—খাঁচা থেকে বাইরে, মহা আনন্দ। এবার তাদের ধরতে হবে, টুনিসাহেব জাল ফেলছে বারে বারে; কিছুতেই তারা ধরা দেয় না। শেষে সে তো জাল-টাল ফেলে দিয়ে চম্পট; ধরা পড়লুম আমি। এইরকম সব ইচ্ছে ছেলেবয়েসে হত। ইচ্ছে হল কাঠবেড়ালির চলা দেখব, খরগোশের লাফ দেখব, অমনি তাদের ঘরের দরজা খুলে নিতুম বাইরে বের করে। ইচ্ছে হত তো, করব কি, কি বল অভিজিৎ?
ও কি ও, স্যাঙাত, সোয়েটার এঁটে এসেছ এরই মধ্যে? আমাদের ছেলেবেলায় কার্তিক মাসের আগে গরম কাপড়ের সিন্দুকই খুলত না ম্যালেরিয়া হলেও। সাদাসিধে ভাবেই মানুষ হয়েছি আমরা। তখন এত উলের ফ্রক, শার্টমাট, সোয়েটার, গেঞ্জি, মোজা পরিয়ে তুলোর হাঁসের মতো সাজিয়ে রাখবার চাল ছিল না। খুব শীত পড়লে একটা জামার উপরে আর একটা সাদা জামা, তার উপরে বড় জোর একটা বনাতের ফতুয়া, এই পর্যন্ত। চীনে বাড়ির জুতে কখনো ক্বচিৎ তৈরি হয়ে আসত—তা সে কোন্ আলমারির চালে পড়ে থাকত খবরই হত না, খেলাতেই মত্ত।
রাত্রে ঘুমোবার আগে দাসীরা আমাদের খানিকটা দুধ খাইয়ে মশারির ভিতরে ঠেলে দিয়ে থাবড়ে থুবড়ে শুইয়ে চলে যেত। তাদেরও আবার নিজেদের একটা দল ছিল। রাত্তিরবেলা দাসীরা সব একসঙ্গে হয়ে, বারান্দায় একটা লম্বা দোলনা ছিল, তাতে বসে গল্পগুজব হাসিতামাসা করত। আন্দিবুড়ি আসত রাত্রে, সে যা চেহারা তার—কপালজোড়া সিঁদুর, লাল টকটক করছে, গোল এত্তো বড় মুখোশের মতো মুখ, যেন আহ্লাদী পুতুলকে কেউ কালি মাখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। দেখতে যদি তাকে রাত্তিরবেলা! সেই আন্দিবুড়ি দক্ষিণেশ্বর থেকে আসত মায়েদের শ্যামা-সংগীত শোনাতে, আর পয়সা নিতে। তার গলার স্বর ছিল চমৎকার। সে যখন চাঁদের আলোতে বারান্দার দোলনাতে চুল এলিয়ে বসে দাসীদের সঙ্গে গল্প করত, মশারির ভিতর থেকে ঝাপসা ঝাপসা দেখে মনে হত, যেন সব পেত্নী—গুজ্গুজ্ ফুস্ফুস্ করছে। তখন ওই একটা শব্দ ছিল দাসীদের কথাবার্তার—গুজ্গুজ্, ফুস্ফুস্। বেশ একটু স্পষ্ট স্পষ্ট কানে আসত। ঘুমই হত না। মাঝে মাঝে আমি কুঁই কুঁই করে উঠি, পদ্মদাসী ছুটে এসে মশারি তুলে মুখে একটা গুড় নারকেলের নাড়ু, তাদের নিজেদের খাবার জন্যেই করে রাখত, সেই একটি নাড়ু মুখে গুঁজে দেয়; বলে, ‘ঘুমো।’ নারকেল-নাড়ুটি চুষতে থাকি। পদ্মদাসী গুন গুন করে ছড়া কাটে আর পিঠ চাপড়ায়; এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তার পরে এক ঘুমে রাত কাবার। তুমি তো অন্ধকার রাত্রে রাস্তায় ভূতের ভয় পাও; আমার পদ্মদাসী আর আন্দিবুড়িকে দেখলে তবে কি করতে জানিনে। দুজনের ঠিক এক চেহারা। আদিবুড়ি ছিল কালো রঙের আহ্লাদী পুতুল, আর আমার পদ্মদাসী ছিল যেন আগুনে ঝলসানো পদ্মফুল।