ওদিকে নিচে রাত দশটার পর নন্দ ফরাসের ঘরে নোটো খোঁড়ার বেহালা শুরু হয়। একটাই সুর অনেক রাত্তির অবধি চলে একটানা। বেহালা যেন সুরে এক দুই মুখস্থ করছে; এক, দুই, তিন, চার; এক, দুই, তিন, চার। ওই থেকে পরে আমি একটা যাত্রার সুর দিয়েছিলুম। বাবামশায়ের বৈঠক ভাঙলে নন্দ ফরাসের ঘরে বৈঠক বসে—ছিরু মেথর, নোটো খোঁড়া, আরও অনেকের। ভোরবেলা বাড়ির সামনে ঘোড়া মলে টপ টপ ধপধপ। কাকপক্ষী ডাকার আগে এই শব্দ শুনেই ঘুম ভাঙে আমার। রোজ ঘুমোবার আগে আর ঘুম ভেঙে এই দুটি শব্দ শুনি—বেহালার এক, দুই, তিন, চার; আর ঘোড়ামলার টপ টপ ধপ ধপ।
তখন এক-একটা সময়ের এক-একটা শব্দ ছিল। এখন সেই শব্দ আর নেই। সব মিলিয়ে যেন কোলাহল চারদিকে। ট্যাক্সির ভোঁ-ভোঁ, দোকানদারের চিংকার, রাস্তার হট্টগোল, এসবে ঘরের কোণায়ও কান পাতা দায়। তার উপরে জুটেছে আজকাল মাথার উপরে উড়োজাহাজের ঘড়ঘড়ানি, রেডিওর ভনভনানি, আরও কত কি। তেতালার ছাদে জ্যোতিকাকামশায়ের পিয়ানোর সুর, রবিকার গান, জ্যাঠামশায়ের হাসির ধমক, কোথায় চলে গেল সে সব!
তা সেই সময়ে দুপুরে বৈঠকখানাতেই একদিন আমি আবিষ্কার করলুম ‘লণ্ডন নিউজে’র ছবি। বাঁধানো ‘লণ্ডন নিউজ’ পড়েছিল এক কোণায়। সব-কিছু ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে গিয়ে বইয়ের ভিতরে ছবির সন্ধান পেলুম। সে কতরকম কাণ্ডকারখানার ছবি, নিবিষ্ট মনে বসে বসে দেখি। একদিন ঘোষাল মাস্টার এসে ঢুকলেন সেই ঘরে। দিব্যি ভুঁড়িদার চেহারা তার; খালি গায়ে যখন আসেন, তেলচুকচুকে ভুঁড়িটি ঠিক যেন পিতলাই হাড়া একটি। তিনি ঘরে ঢুকে বললেন, ‘দেখি কি দেখছ’—বলে আমার হাত থেকে বইগুলি নিয়ে পাতা উলটে উলটে দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে একটা পাতায় আছে ফরাসী রানীর ছবি, তিনি সেই ছবিটি সামনে রেখে হাতজোড় করে তিনবার মাথায় ঠেকালেন। তারপর থেকে দেখি রোজই তিনি স্নানের পর ফরাসী রানীর ছবি বের করে তিনবার পেন্নাম করেন। কারণ আর বুঝিনে কিছু। দেবদেবীর ছবি এ নয়, তবে কেন এত পেন্নামের ঘটা। শেষে বড়দাকে একদিন জিজ্ঞেস করি, ‘এর মানে কি বলে না।’ বড়দা হেসে বললেন, ‘ওহো তা বুঝি জানিসনে? ঘোষাল মশায়কে জিজ্ঞেস করেছিলুম যে, তিনি বললেন, এই ফরাসী রানী তাঁর স্ত্রীর মতো দেখতে। তাই রোজ তিনি ওই ছবিকে পেন্নাম করেন।’
০৪. ছেলেবেলায় খুব গান আর ছবি-আঁকা
সেদিন কে যেন আমায় বললে, আপনি বুঝি ছেলেবেলায় খুব গান আর ছবি-আঁকার আবহাওয়ায় বড় হয়েছেন? বললুম, মোটেও তা নয়। কি আবহাওয়ার ভিতর দিয়ে বড় হয়েছি জানতে চাইছ? শোনো তবে।
ছবি গান ছিল বইকি বাড়িতে। বাবামশায়ের শখ ছিল ছবি আঁকার; জ্যোতিকাকামশায়ও ছবি আঁকতেন, পোর্ট্রেট আঁকবার ঝোঁক ছিল তার; কিন্তু ছবি দেখা তো দূরের কথা, আমরা কি তাঁদের ঘরে ঢুকতে পেরেছি কখনও?
গানবাজনাও হত। তখনকার দিনে মাইনে-করা গাইয়ে থাকত বাড়িতে। কেষ্ট বিষ্ণু ছিল দুই মাইনে-করা গাইয়ে। দুর্গাপুজোয় আগমনী বিজয়া তখন গাইত তারা—শোননি কখনও? ভারি মিষ্টি সেসব গান। ওস্তাদি গানের মজলিশও বসত বৈঠকখানায় রোজ সন্ধ্যেবেলা। তখনকার নিয়মই ছিল ওই। পাড়াপড়শি বন্ধুবান্ধব আসতেন বৈঠকি গান শুনতে। নটার তোপও পড়ত, মজলিশও ভেঙে যে যার ঘরে যেতেন। দূর থেকে যেটুকু শুনতুম কিছুই বুঝতুম না তার।
তবে হ্যাঁ, গান হত ও-বাড়িতে, তেতলার ছাদে নতুনকাকিমার ঘরে। একদিকে জ্যোতিকাকামশায় পিয়ানো বাজাচ্ছেন, আর একদিকে রবিকা গাইছেন। সেই অল্পবয়সের রবিকার গলা, সে যেমন সুর তেমনি গান। মাত করে দিতেন চারদিক। এ-বাড়ি থেকে শুনতুম আমি কান পেতে। তাই বলি, গান তবু শুনেছি আমি ছেলেবেলায়; কিন্তু ছবি দেখিনি মোটেও।
ছবি যা দেখেছি তা আমার ছোটপিসিমার ঘরে। ছুটির দিন দুপুরবেলা ছোটপিসিমার ঘরের দরজায় একটু উঁকিঝুঁকি মারতেই ছোটপিসিমার নজরে পড়ি, তিনি ডাকেন, ‘কে রে অবা? আয় আয় ঘরে আয়।’ কি সুন্দর ঘরটি তাঁর। কতরকমের ছবি, দেশী ধরনের অয়েল-পেটিং, শ্রীকৃষ্ণের পায়েস ভক্ষণ— সামনে নৈবেদ্য সাজিয়ে মুনি চোখ বুজে ধ্যানে বসে আছেন, চুপি চুপি কৃষ্ণ হাত ডুবিয়ে পায়েসটুকু তুলে মুখে দিচ্ছেন, হুবহু কথকঠাকুরের গল্পের ছবি; শকুন্তলার ছবি—তিনটি মেয়ে বনের ভিতর দিয়ে চলেছে, শকুন্তলা বলে বুঝতুম না, তবে ভালো লাগত দেখতে; মদনভস্মের ছবি—মহাদেবের কপাল ফুঁড়ে ঝাঁটার মতো আগুন ছুটে বের হচ্ছে; সরোজিনী নাটকের ছবি; কাদম্বরীর ছবি—রাজপুত্তুর পুকুরধারে গাছতলায় ঘোড়া বেঁধে শিবমন্দিরের দাওয়ায় বসে আছে। কে জানে তখন, সেটা কাদম্বরীর ছবি। এমনি কত সব ছবি। কেষ্টনগরের পুতুলই বা কত রকমের ছিল সেই ঘরে। চেয়ে চেয়ে দেখতে বেলা কাটে। মেঝেতে ঢালা-বিছানায় বুকে বালিশ দিয়ে বসে ছোটপিসিমা পান খান, সেলাই করেন। ও-বাড়িতে বেলা তিনটের ঘণ্টা পড়ে। গুপীদাসী চুল বাঁধার বাক্স, মাদুর নিয়ে আসে। ছোটপিসিমা উঠে উঁচু-পাঁচিল-ঘেরা ছাদে গিয়ে চুল বাঁধতে বসেন, পোষা পায়রাগুলো খোপ থেকে বেরিয়ে এসে ছোটপিসিমাকে ঘিরে ঘাড় নেড়ে বকম বকম বকে বকে নাচ দেখায়। ছোটপিসি আমার হাতে মুঠো মুঠো দানা দেন; ছড়িয়ে দিই, তারা চক্কর বেঁধে কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেয়ে উড়ে বসে ছাদের কার্নিশে সারি সারি। পড়ন্ত রোদ তাদের ডানায় ডানায় ঝকমক করে। কোনো কোনো দিন বা দেখি ঘূর্নি হাওয়ায় লাল ধুলো পাক খেয়ে খেয়ে উড়ে গেল। বাইরের ছবিও দেখি। আবার খেলাধুলোর শেষে ঘরের কোণায় সন্ধ্যেবেলা পিতলের পিলসুজের উপর পিদিম জলে, তারই কাছে টিকটিকি নড়েচড়ে পোকা ধরে, তাও দেখি চেয়ে চেয়ে অনেকক্ষণ। এইরকম ঘর-বাইরের কত কি ছবি দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি।