জগন্নাথের মন্দিরেও ঘুরি রোজ। নাটমন্দিরের ধারে ছোট্ট একটি ঘর, ছোট্ট দরজা, বন্ধই থাকে বেশির ভাগ। পাণ্ডা বললে, ভোগমূর্তি থাকে এখানে। জগন্নাথের বড় মূর্তি সব সময়ে নাড়াচাড়া করা যায় না, ওই মূর্তি দিয়েই কাজ চালায়। সে ঠিক ঘর নয়, একটি কুঠরি বললেই হয়। বললুম, ‘দেখতে চাই আমি।’ পাণ্ডা দরজা খুলে দিলে। দেখি চমৎকার চমৎকার ছোট্ট ছোট্ট মূর্তি সব। দেখেই লোভ হল। ছোট আছে, নিয়ে যাবারও সুবিধে। পাণ্ডাকে জিজ্ঞেস করলুম। সে বললে, ‘হবে না, ও হবে না বাবু।’ ফুসলে ফাসলে কিছু যখন হল না, দেখি তা হলে হাতানো যায় কিনা কিছু। ঘুরে ঘুরে সব জেনে শুনে সাহসও বেড়ে গেছে।
তখন স্নানযাত্রা। জগন্নাথকে নিয়ে রথ চলেছে, সবাই সেখানে, মন্দির খালি। আমার মন পড়ে আছে ছোট ছোট মূর্তিগুলোর উপর। আমি চুপি চুপি মন্দিরে ঢুকে সোজা উপস্থিত সেই পুতুলঠাসা কুঠরির কাছে, দেখি দরজা খোলা, ভিতর অন্ধকার। মস্ত সুবিধে, এবার চৌকাঠ পেরলেই হয়। আর দেরি নয়। দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিয়েছি কি অন্ধকার থেকে এক মূর্তি বলে উঠল, ‘কি বাবু, আপনি? আজ তো এখানে কিছু নেই, সব স্নানযাত্রায় চলে গেছে ।’ কি রকম থমকে গেলুম। ভিতরে যে কেউ বসে আছে একটুও টের পাইনি।
যাক, বাড়ি ফিরে এলুম ভাঙা মনে। সে রাত্রে স্বপ্ন দেখি, আমি যেন সেই কুঠরিতে ঢুকে একটা মূর্তি তুলে আনব ভেবে যেই তাতে হাত দিয়েছি মূর্তি হাত আর ছাড়ে না। চীৎকার করছি, ‘ওমা দেখ দেখ, হাত তুলে আনতে পারছিনে।’ দম বন্ধ হয়ে আসে স্বপ্নে। সকালে উঠে মাকে বললুম সব। মা বললেন, ‘খবরদার, কিছুতে হাত দিসনে, তবে সত্যিই হাত আটকে যাবে। সাবধান, ঠাকুরদেবতা নিয়ে কথা, আর কিছু নয়।’
কিন্তু কি বলব—এমন সুন্দর মূর্তি, তাকে চুরি করারও লোভ জাগায়।
তার পর আর-একদিন আর-একটা মূর্তি দেখলুম। নরেন্দ্রসরোবরের ধারে অনেক মূর্তি আছে, পাণ্ডারা ঘুরে ঘুরে দেখালে। তেমন কিছু নয়, পয়সা ফেলে ফেলে যাচ্ছি। একপাশে ছোট্ট একটা মন্দির, ভাঙা দরজা। বললুম, ‘এটাতে কি আছে দেখাও।’ পাণ্ডা বললে, ‘ওতে কিছু নেই, বাবু। ওটা এক বুড়ির মন্দির।’
বুড়িকে বললুম, ‘দেখা না বুড়ি তোর মন্দির।’ সে বললে, ‘দেখবে এসো।’ দরজাটি খুলে দেখাতেই একটি কালো কষ্টিপাথরের বংশীধারী মূর্তি, মানুষপ্রমাণ উঁচু, একটি হাত ভাঙা, যাকে বলে চিকনকালা বংশীধারী। কি তার সূক্ষ্ম কাজ, কি তার ভঙ্গি! কোথাও এমন দেখিনি। বুড়িকে বলেছিলুম, ‘মন্দির গড়িয়ে দেব, নতুন মূর্তি তৈরি করিয়ে দেব, এটি আমায় দে।’ রাজি হল না। নন্দলালদের বলেছিলুম, ‘যদি যাও, ভালো মূর্তি দেখতে চাও, সেটি দেখে এসো।’ এখনো সেই বুড়ি আছে কিনা, মূর্তি আছে কিনা কে জানে। পাণ্ডারা আমল দেয় না। বোধ হয় ভাঙা বলে ফেলে দিয়েছিল, বুড়ি তাকে পূজো করত। প্রাণ ঠাণ্ডা হয়ে গেল, কিন্তু ঘরে আনতে পারলেম না এই দুঃখ রইল।
তোমরা ‘ভারতশিল্প’‘ভারতশিল্প’ কর, দরদ কি আছে কারো? না পুরীর রাজার, না ম্যানেজারের, না পাণ্ডাদের, দরদ কারো নেই। প্রমাণ দিই।
জগন্নাথের মাসির বাড়ি মেরামত হবে। পাণ্ড খবর দিলে, ‘বাবু, দুটো হরিণ যদি কিনতে চাও মাসির বাড়ির, বিক্রি হবে।’
বললুম, ‘সে কি রে? পোষা হরিণ সেখানে বড় হয়েছে। আমার দরকার নেই সে হরিণের। ভাঙা মূর্তি থাকে তো বল্।
পাণ্ডা বললে, ‘সে কত চাই বাবু, বলুন। অনেক মিলবে।’
বললুম, ‘আজই চল্ তবে সেখানে দেখি গিয়ে।’
গেলুম, তখন সন্ধ্যেবেলা। সে গিয়ে যা দেখি। মাসির বাড়ি যেন ভূমিকম্পে উলটে পালটে গেছে। চুড়োর সিংহ পড়েছে ভুঁয়ে, পাতালের মধ্যে যে ভিত শিকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতকাল সে শুয়ে পড়েছে মাটির উপরে, সব তছনছ। বড় বড় সিংহ নিয়ে কি করব? ছোটখাটাে মূর্তি পেলে নিয়ে আসা সহজ। ভিতরে গেলুম। সেখানেও তাই। এখানকার জিনিস ওখানে। কেমন একটা ত্রাস উপস্থিত হল। পাণ্ডাকে শুধালেম, এই পাথরের কাজ ঝেড়ে ঝুড়ে পরিষ্কার করে যেমন ছিল তেমনি করে তুলে দেওয়া হবে তো মেরামতের সময়?
তার কথার ভাবে বুঝলেম এই সব জগদ্দল পাথর ওঠায় যেখানকার সেখানে, এমন লোক নেই। বুঝলেম এ সংস্কার নয়, সৎকার। ভাঙা মন্দিরে মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে একজোড়া প্রকাণ্ড নীল হরিণ চার চোখে প্রকাণ্ড একটা বিস্ময় নিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এল। কতকালের পোষা হরিণ, এই মন্দিরের বাগানে জন্ম নিয়ে এতটুকু থেকে এত বড়টি হয়েছে—আজ এদের বিক্রি করা হবে। আর, এদের সঙ্গে সঙ্গে যে বাগান বড় হতে হতে প্রায় বন হয়ে উঠেছে, বনস্পতি যেখানে গভীর ছায়া দিচ্ছে, পাথি যেখানে গাইছে, হরিণ যেখানে খেলছে, সেই বনফুলের পরিমলে ভরা পুরোনো বাগানটা চষে ফেলে যাত্রীদের জন্য রন্ধনশালা বসানো হবে।
আমার যন্ত্রণাভোগের তখনও শেষ হয়নি। তাই ঘুরতে ঘুরতে একটা ডবল তালা দেওয়া ঘর দেখিয়ে বললেম, ‘এটাতে কি? পাণ্ডা আস্তে আস্তে ঘরটা খুললে, দেখলেম, মিণ্টন আর বর্ন্ কোম্পানির টালি দিয়ে অতবড় ঘরখানা ঠাসা।
‘এত টালি কেন?’
‘মাসির বাড়ি ছাওয়া হবে।’
আঃ সর্বনাশ, এরি নাম বুঝি মেরামত? ভাঙার মধ্যে, ধ্বংসের স্তূপে, রস আর রহস্য, নীল দুটি হরিণের মত বাসা বেঁধে ছিল। সেই যে শোভা, সেই শান্তি মনে ধরল না; ভালো ঠেকল দুখানা চকচকে রাঙা মাটির টালি!