ধ্যানধারণা কেন করিনে জানো? একবার কি হল বলি। এখন আর ডাক্তারদের আমার লিভার ছুঁতে দিইনে। বলি, ‘ও আমার ঠিক আছে। আর যা করতে হয় কর, লিভারে হাত দিতে পারবে না।’ তা সেইবারে কোথাও কিছু না, হঠাৎ লিভারে দারুণ যন্ত্রণা। সে কি যন্ত্রণা। লিভার থেকে বুক অবধি যেন অগ্নিশূল বিঁধছে। সেই অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে শেষটায় বেঁহুশ হয়ে পড়ি। তিন-চারজন ডাক্তার চিকিৎসা করছেন। সকালের দিকে ভালো থাকি, বিকেলে ব্যথা শুরু হয়। ব্যথা শুরু হবে এই ভয়েই আমি আরো অস্থির হয়ে পড়ি বেশি। বিকেল হবার সঙ্গে সঙ্গে আমারও আতঙ্ক আরম্ভ হয়, এই বুঝি উঠল ব্যথা। যেন স্টেশনে জানান দিলে, এবারে ট্রেন আসছে বলে। একদিন সকাল থেকেই ব্যথা শুরু হয়েছে, যন্ত্রণায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছি ছেলেমাহষের মত চীৎকার করছি ‘গেলুম গেলুম।’ করুণা, নেলি, ওরা এসে জড়িয়ে ধরলে, আর বুঝি বাঁচিনে এমন অবস্থা। তিন-তিনটে মরফিয়া ইনজেকশন দিলে ডাক্তাররা; একটা সকালবেলা, একটা দুপুরে, আর একটা রাত দশটায়। ডাক্তারদের বললুম, ‘আর যা হোক একটু ঘুম পাড়িয়ে দিন আমায়, পারছিনে সইতে।’ ডাক্তাররা ভেবে মরেন, একই দিনে তিনটে মরফিয়া ইনজেকশন। তাঁরা বলেন, যে দু ডোজ মরফিয়া দেওয়া হয়েছে তাতে যে হাতিরও ঘুমিয়ে পড়বার কথা। যাই হোক আর একটাও তাঁরা দিলেন।, বললেন, ‘এতেই যা হবার হবে, আর চলবে না।’ এই বলে তারা চলে গেলেন সে-রাত্তিরের মত। আমি ঘর থেকে সবাইকে বের করে দিলুম। বললুম, ‘সবাই চলে যাও এ ঘর ছেড়ে, আমি আজ একলা থাকব।’ রাতও হয়েছিল অনেক, কদিনের উৎকণ্ঠায় ক্লান্তিতে যে যার ঘরে গিয়ে শোবামাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছে। সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। আমি বিছানায় শুয়ে আছি বড় বড় করে দু-চোখ মেলে—ঘুমই আসছে না তা চোখ বুজব কি? চেয়ে চেয়ে দেখছি, একটু একটু মরফিয়ার ক্রিয়া চলেছে। দেখি কি, আমার চারদিকের মশারিটা কেমন যেন কাঁপতে কাঁপতে সরে গেল,—দেয়ালও তাই। উকুনের উপর দেখ না হাওয়া গরম হয়ে কেমন কাঁপতে থাকে, দুপুরে মাঠের মাঝেও সেই রকম দেখা যায়, মরীচিকা—সেই মরীচিকার মত দেয়ালগুলো কাঁপছে চোখের সামনে। মনে হতে লাগল যেন ইচ্ছে করলেই তার ভিতর দিয়ে গলে যেতে পারি। এই হতে হতে রাত্রি প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। চেয়েই আছি হঠাৎ দেখি, একখানি হাত, মার হাতখানি মশারির উপর থেকে নেমে এল। দেখেই চিনেছি, অসাড় হয়ে পড়ে আছি—মনে হল মা যেন বলছেন, ‘কোথায় ব্যথা? এইখানে?’ ব’লে হাতটি এসে টক করে লাগল ঠিক বুকের সেইখানটিতে। সমস্ত শরীরটা যেন চমকে উঠল, ভালো করে চারদিকে তাকালুম, কেউ কোথাও নেই। ব্যথা? নড়ে চড়ে দেখি তাও নেই। অসাড় হয়ে শুয়ে ছিলুম, নড়বার শক্তিটুকুও ছিল না একটু আগে—সেই আমি বিছানায় উঠে বসলুম। কি বলব, নিজের মনেই কেমন অবাক লাগল।
বিছানা ছেড়ে ধীরে ধীরে বাইরে এলুম, দিব্যি মানুষ, অসুখের কোনো চিহ্ন নেই। দোরগোড়ায় চাকর শুয়ে ছিল, সে ধড়মড় করে উঠে এগিয়ে এল। বললুম, ‘কাউকে ডাকিসনে। চুপচাপ একটু ঠাণ্ডা জল দে দেখিনি আমার হাতে।’ সে ঠাণ্ডা জল এনে দিলে, আমি তা ভালো করে মুখে মাথায় দিয়ে বেশ ঠাণ্ডা হয়ে চাকরকে বললুম, ‘যা এবারে আমার জন্যে এক পেয়াল চা, পুরু করে মাখন দিয়ে দুখানি পাঁউরুটি টেস্ট তৈরি করে, বাইরে বারান্দায় যেখানে বসে আমি ছবি আঁকি সেখানে এনে দে। আর দেখ্, তামাকও সেজে আনবি ভালো করে।’ চাকর নিয়ে এল। গরম গরম চা রুটি খেয়ে গড়গড়ার নলটি মুখে দিয়ে আরাম করে টানতে লাগলুম। তখন পাঁচটা বেজেছে, দাদা তেতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমায় বারান্দায় বসে থাকতে দেখে অবাক। বললেন, ‘এ কি, তুমি যে বাইরে এসে বসেছ?’ বললুম, ‘ভালো হয়ে গেছি। দাদা।’ নেলি, করুণা, অলকের মা, তার উঠে দেখে বিছানায় রুগী নেই। গেল কোথায়? এঘরে ওঘরে খোঁজাখুঁজি করে বারান্দায় এসে সকলে চেঁচামেঁচি, ‘কখন তুমি আবার বাইরে উঠে এলে, একটুও জানতে পারিনি।’ বললুম, ‘জানবে কি করে, আমি যে ভালো হয়ে গেছি একেবারে। আর তোমরা ভেবো না মিছে।’ বলতে বলতেই মহেন্দ্রবাবু ডাক্তার এসে উপস্থিত। আমায় বারান্দায় দেখেই থমকে দাঁড়ালেন। বললুম, ‘আর আপনাদের দরকার নেই।’ মহেন্দ্রবাবু হেসে বললেন, ‘ভালো কথা, সেরে উঠেছেন তা হলে? খাওয়াদাওয়া কি করলেন? বেশ বেশ, এবারে সুস্থ মানুষের মত চলাফেরা করুন। দেখুন কি রকম আপনার রোগ তাড়িয়ে দিয়েছি আমরা।’ মহেন্দ্রবাবু থাকতে থাকতেই ডাক্তার ব্রাউন উঠে এলেন খটখট করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে। আমাকে কুশলপ্রশ্ন করতেই তার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে হ্যাণ্ডশেক করে বললুম, ‘গুডবাই, ডাক্তার। আর তোমার দরকার নেই, যেতে পারো তুমি।’ সাহেব হাসিমুখে চলে গেলেন।
তাঁরা চলে যেতে মনে খটকা লাগল। ডাক্তারদের ফিরিয়ে দিলুম, বললুম, আর দরকার হবে না; কি জানি যদি আবার ব্যথা ওঠে বিকেলের দিকে। মনটা কেমন খুঁতখুঁত করতে লাগল। এমন সময়ে অমরনাথ হোমিয়োপ্যাথ ডাক্তার এসেছেন আমার খবর নিতে, তাঁকে বললুম, একটু হোমিয়োপ্যাথিই আমায় দিয়ে যাও, রেখে দিই। যদি ব্যথা ওঠে তো খাব।’ তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই, আমি এখনি গিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ তিনি চলে যেতে এলেন বৃদ্ধ ডি. এন. রায়, তিনিও ডাক্তার, মাকে দেখতেন শুনতেন, প্রায়ই আসতেন, তিনি এসেছেন আমায় দেখতে—খবর রটে গিয়েছিল চারদিকে, আজ রাত কাটে কি না-কাটে, এমন অবস্থা। বৃদ্ধ এসেই বললেন, ‘হবে না লিভারে ব্যথা? এই বয়সে এতগুলি বই লেখা?’ ‘এতগুলি বই আবার কোথায়?’ তিনি বললেন, ‘তা নয় তো কি? বাড়ির মেয়েরা সেদিন পড়ছিল দেখলুম যে আমি।’ সে তো দুখানি মাত্র বই, শকুন্তলা আর ক্ষীরের পুতুল।’ ‘ওই হল। দুখানাই কি কম? এই বয়সে দুখানা বই লিখলে, এত এত ছবি আঁকলে, তোমার লিভার পাকবে না তো পাকবে কার?’ এতখানি বয়সে ছেলেদের জন্য দুখানি মাত্র বই লিখেছি, সেই হয়ে গেল এতগুলি বই লেখা। হেসে বাঁচিনে তাঁর কথা শুনে।