বাড়ি নিয়ে এলুম সতীর ছবি। মনে মনে ভাবছি কি উপায় করা যায় এর। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল একটা কোনো বইয়ে পড়েছিলুম খোলা হাওয়া-আলোতে রাখলে কতকগুলো রঙের জলুস ফিরে আসে। ভাবলুম, কি জানি, জিঙ্ক দিয়ে মুড়ে পাঠিয়েছিল ছবি, জিঙ্কের গরমে ও জাহাজের গুমটে মিলে কেমিক্যাল ক্রিয়ায় হয়তো রঙ বদলে গিয়ে থাকবে। বাড়িতে এসে ছবিখানি আমার শোবার ঘরে জানলার পাশটিতে টাঙিয়ে রাখলুম। পুবের আলো এসে পড়ে তাতে রোজ। রইল তো সেখানেই। কিছুদিন বাদে একদিন দেখি, সতীর রঙ ফিরে গেছে, সেই আগের রঙ এসে লেগেছে গায়ে, আলো দিয়ে যেন ধুইয়ে দিয়েছে তার পোড়া রঙ। বাঃ বাং, এ তো বড় মজা। উড্রফকে ডেকে এনে দেখাই, থর্নটনকে ডেকে এনে দেখাই। তাঁরাও দেখে অবাক। থর্নটনকে বললুম, ‘কি, লোভ হচ্ছে নাকি? কিন্তু পাবে না আর ফিরে। আমার কাছে এসে সতীদেহের রঙ ফিরে এলো, আর কি দিই তোমার হাতে তুলে?’ সাহেব শুনে হাসেন, বলেন, ‘না, এ তোমারই থাক্।
থর্নটনের মত অমন বন্ধ হয়নি আর আমার। তাঁরই চাপরাসিকে দিয়েছিলেন আমার কাছে ছবি আঁকা শিখতে। বলিনি সে গল্প বুঝি? একবার সাহেব যাবেন দেশে, চাপরাসিকে দিয়ে গেলেন আমার কাছে। বললেন, ‘এর ছবি আঁকার হাত আছে, একে তুমি ছবি আঁকা শেখাও; খরচপত্তর যা লাগে তা আমি দেব। সাহেব চলে গেলেন দেশে; পরদিন চাপরাশি এল আমার আর্ট স্কুলে। সাহেবেরই একটা লাল নীল পেনসিল দিয়ে ট্রামগাড়ি, কলকাতার রাস্তা, এই সব আঁকত অবসর সময়ে। বসিয়ে দিলুম তাকে নন্দলালের সঙ্গে। তাদের বললুম, ‘এও একজন ছাত্র, একে যেন অবজ্ঞা কোরো না। এখানে সবার আসন সমান।’ চাপরাসি দাঁড়িয়ে আছে একপাশে; বললুম, ‘বোস তুই এখানে এই বেঞ্চিতে।’ সে কেবলি কাঁচুমাঁচু করে; কিছুতেই বসতে চায় না। তাকে ভালো ভাবে বসাতেই আমার লাগল বেশ কিছুদিন। রোজই সে আসে, ছবি আঁকে। কি আর তেমন আঁকবে এই কয়দিনে, তবু হাত তার ধীরে ধীরে বেশ পাকা হয়ে আসছিল। সাহেব দেশ থেকে ফিরে এলেন, চাপরাসি আবার তার কাজে যোগ দিলে। একদিন সাহেব এসে বললেন ‘তুমি আমার চাপরাসির করেছ কি? ছবি আঁকার কথা ছেড়ে দাও, লোকটা একেবারে বদলে গেছে। তার শিষ্টতা আচারব্যবহার কথাবার্তা আমাকে মুগ্ধ করছে। আগের সেই চাপরাসি আর নেই, তুমি আগাগোড়া লোকটাকে এমন করে বদলে দিলে কি করে?’ বললুম, ‘আর কিছু নয়, আমি শুধু ওকে বসতে শিখিয়েছিলুম।’
সে সময়ে বাংলাদেশের যত জমিদার মিলে একটা সোসাইটি হয়, নাম ল্যাণ্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন। সিংহ মশায় সভাপতি। উড্রফ আর ব্লান্টও জুটল সে সময়ে। সুরেন কোমর বেঁধে কাজ করে তাতে। সুরেনের মাথায়ই খেলল প্রথমে একটা ছবির একজিবিশন করতে হবে। আমার যা কখানা ছবি ছিল, ওকাকুরা এনেছিলেন সঙ্গে কিছু জাপানী প্রিন্ট, আর এখান-ওখান থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে জোগাড় করলে আরও কখানা ছবি। তাই নিয়ে সে তৈরি একটা মস্ত বাড়ি ছিল ল্যাণ্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের; নিচের তলায় বিলিয়ার্ড রুম, পড়বার ঘর, উপরে ব্যবস্থা আছে কোন সভ্য দূর থেকে এলে থাকতে পারে সেখানে, সুরেন চাইলে সেই বিলিয়ার্ড-রুমেই একজিবিশন হবে। সিংহ মশায় বললেন, ‘ছবির আমি বুঝিনে কিছুই; তবে চাইছ ঘর একজিবিশন সাজাতে, তা নাও।’ সেই বিলিয়ার্ড-রুমেই ছবি সব সাজানো হল। বেশ লোকজন আসত দেখতে; আমাদেরও ভাল লাগত, ইচ্ছে ছিল আরো কয়েকদিন চলে এমনি। এদিকে ছোকরা ব্যারিস্টার ছিলেন অনেক সেই অ্যাসোসিয়েশনে, নতুন বিলেতফেরত, তাঁরা রোজ সন্ধ্যেয় আসেন, বিলিয়ার্ড খেলেন, ব্রিজ খেলার আড্ডা জমান, তাঁদের হল মহা অসুবিধে। কদিন যেতে না-যেতেই তাঁরা লাগলেন গজগজ করতে, ‘ঘর আটকে রাখা হয়েছে।’ গজগজানি শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ছবি-টবি নামিয়ে নিলুম দেয়াল থেকে। সেই একজিবিশনে উড্রফ, ব্লান্ট, এঁদের সঙ্গে আলাপ জমল। সেই হল প্রথম আমাদের ছবির একজিবিশন। তার দু-তিন বছর পরে হ্যাভেল চাইলেন তাদের সেই ছোট্ট আর্ট-ক্লাবটা ভালো করে তৈরি করতে। কমিটি গঠন হল, আমরা তাতে যোগ দিলুম। ল্যাণ্ডহোল্ডার্সদেরও কেউ কেউ এলেন। উত্তরপাড়ার রাজা প্যারীমোহনও এলেন। লর্ড কিচনার সভাপতি, আমাকে হ্যাভেল বলেন সম্পাদক হতে। আমি বলি, ‘ওসব হিসেব-নিকেশে আমি নেই। পারিনে কোনোকালে।’ কিছুতেই ছাড়েন না, শেষে যুগ্ম সম্পাদক হই। জানো, বেশ কিছুকাল আমি লর্ড কিচনারের সম্পাদকগিরি করেছি। একবার এক পার্ট দিলেন ফোর্ট উইলিয়ামে। এখানে শান্ত্রী, ওখানে শান্ত্রী, বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। দেখে তো বুক আঁতকে আঁতকে ওঠে। রাস্তাও কি রকমের; গাড়ি ঘুরে ঘুরে পৌঁছল দোতলায় না তেতলায় ঠিক ওঁর ঘরটির সামনে। নানারকম জিনিসের সংগ্রহ ছিল তার। প্রায়ই যেতে হত সেখানে। এখন সেই পার্টিতে এসেছেন অনেকেই নিমন্ত্রিত হয়ে। এক রাজা বন্ধু ধরলেন, ‘আমায় লর্ড কিচনারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হবে।’ সাহেব দেখি তখন মেমের সঙ্গে গল্পে মশগুল এক ফুলবাগানে। ভাবভঙ্গী দেখেই মনে হচ্ছে, বেশ জমে উঠেছে। ভাবলুম, দরকার নেই বাপু এখন গিয়ে, কি জানি মিলিটারি মেজাজ, দেবে হয়তো এখনি মাথাটা গুড়িয়ে। রাজ-বন্ধু এদিক থেকে কেবল খোঁচাচ্ছেনই। কি করি, একপায়ে দুপায়ে এগিয়ে গেলুম খানিকটা। সাহেব কথার ফাঁকে একবার পিছনে তাকিয়েছেন কি, রাজাকে ঠেলে দিলুম, বললুম, ‘ইনি হচ্ছেন রাজা অমুক।’ সাহেব হাত ঝাঁকুনি দিয়ে হ্যাণ্ডশেক করে বললেন, ‘Well Tagore, take him upstairs and show him my collection, please.’ রাজাকে নিয়ে চলে গেলুম সেখান থেকে। রাজা তো খুব খুশি ওইটুকু হ্যাণ্ডশেক করতে পেয়েই। যাক সেকথা। এখন এই সোসাইটির নাম কি দেওয়া যায়? কেউ কেউ প্রস্তাব করলেন অরিয়েটাল আর্ট সোসাইটি। আমি বললুম, ‘না, নাম হোক্ এর ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট। শুধু বাঙালি নয়, দুই সম্প্রদায় মিলল এতে। দাদাও ছিলেন। অনেকে স্থায়ী সভ্য হলেন। পার্ক স্ট্রীটে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল, আর্টিস্টরা কাজ করবে সেখানে; কেউ যদি ইচ্ছে করে থাকতেও পারে, এমন ব্যবস্থা রইল। আর্ট স্কুলের মস্ত হলে দু-তিনটে ছবির একজিবিশন হল। উড্রফ তার জাপানি প্রিন্টের কালেক্শন দিলেন। Gesiking বলে এক মেম সব ঋতুর ফুল এঁকেছিলেন দেশি ধরনে, তাও একবার দেখান হল। দেখতে দেখতে আমাদের সোসাইটি খুব জমে উঠল। মাৰ্চেণ্ট কমিউনিটি, সিভিলিয়ান কমিউনিটি, লাটবেলাট জজ-ম্যাজিস্ট্রেট রাজারাজড়া সবাই তাতে যোগ দিয়েছেন; সবাই কিছু-না-কিছু করছেন। উড্রফ ক্যাটালগ লিখতেন। তখনকার ক্যাটালগ সাহিত্য ছিল বললেই হয়। প্রতি ছবির নিচে গল্প থাকত; আমার ইংরেজি বিদ্যেয় কুলোত না, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কোনো রকম করে লিখে দিতুম। উড্রফ তা থেকে ভালো করে লিখতেন।