আর্ট স্কুলে মাঝে মাঝে এক সন্ন্যাসী আসত। চাপরাসিরা ধরে নিয়ে আসত গাছতলা থেকে ক্লাসে মডেল করবার জন্য। আসে, মডেল হয়ে বসে, ছেলেরা আঁকে, ক্লাস শেষ হলে পয়সা নিয়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে দেখি সন্ধ্যের দিকে বা সকালে সন্ন্যাসী হ্যাভেলের ফ্ল্যাট থেকে বের হয়। ব্যাপার কি। হ্যাভেলের মেম বলেন, ‘আর পারিনে অবনবাবু। কোন্ এক সাধু জুটেছে, সাহেব তার কাছে ধ্যান শেখে, যোগ শেখে। সারাক্ষণ কেবল ওই করছে।’ আমি বললুম, ‘এ তে ভালো কথা নয়। যত সব বাজে সাধুসন্ন্যেসীর পাল্লায় পড়ে না ঠকেন শেষ পর্যন্ত।’ একদিন বিকেলে সেই সাধু আমার আপিসঘরে এসে উপস্থিত। বললে, ‘এই নাও পাকা হরীতকী। এটি খেলে যৌবন অক্ষুণ্ণ থাকবে, বয়স বাড়বে না, চুল পাকবে না’—কত কী। বলে লাল বকুলবিচির মত একটা কি হাতে গুঁজে দিলে। সন্ন্যাসী চলে যেতে আমি সেটি পকেটে ফেলে রাখলুম। ভাবলুম খেয়ে শেষে মরি আর কি। খানিক বাদে হ্যাভেল সাহেব এলেন আমার ঘরে, বললেন, ‘সন্ন্যাসী এসেছিল তোমার কাছে? কি দিল তোমায়?’ আমি পকেট থেকে সেটি বের করে বললুম, ‘এইটি।’ সাহেব বললেন, ‘আমায়ও একটা দিয়েছিল। আমি খেয়ে ফেলেছি।’ বললুম, ‘করেছ কি তুমি? না জেনে শুনে তুমি খেলে কি বলে?’ খেয়ে ফেলেছেন, কি আর হবে। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। বাড়ি ফেরবার পথে সেই পাকা, হরীতকী পকেট থেকে বের করে রাস্তায় ফেলে দিলুম। কি জানি চিরযৌবনের লোভ যদি বা জাগে সাহেবের মত।
এমনি কতরকম চরিত্রের লোক নজরে পড়ত তখন।
১২. হ্যাভেল সাহেবদের একটা সোসাইটি ছিল
হ্যাভেল সাহেবদের একটা সোসাইটি ছিল জনকয়েক সাহেব মেম আর্টিস্ট নিয়ে। সন্ধ্যেবেলা আর্ট স্কুলেই তারা ঘণ্টা দুয়েক কাজ করত; আলোচনা সমালোচনা হত, মাঝে মাঝে খাওয়া-দাওয়াও চলত, অনেকটা আর্ট ক্লাব গোছের। মার্টিন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার থর্নটন সাহেবই দেখাশোনা করতেন। তাঁর উপরেই ছিল ওই আর্ট ক্লাবের সব কিছুর ভার। চমৎকার আঁকতেও পারতেন তিনি। অমায়িক সৎ লোক ছিলেন, মহৎ প্রাণ ছিল তার। অমন সাহেব দেখা যায় না বড়। আমার সঙ্গে খুব জমত। সেই থেকেই আমার সঙ্গে তার আলাপ। পরে আমাদের সোসাইটির সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। আমি যখন আর্ট স্কুলে তিনি আসতেন আমার কাছে প্রায়ই; আবার ডেকেও পাঠাতেন কখনও কখনও। চারটের পরে যেতুম তার আপিসে। খুব বিশ্বাস ছিল আমার প্রতি, টেবিলের দেরাজ থেকে তাঁর আঁকা নানারকম স্থাপত্যকর্মের প্ল্যান বের করে আমায় দেখাতেন, পরামর্শ চাইতেন। কোন্টা কি রকম হলে আরো ভালো হয় দু বন্ধুতে মিলে বলা কওয়া করতুম। সেই সময়ে দেখেছি তার ড্রইং। ভারি সুন্দর। ভারতবর্ষের নানা জায়গা ঘুরেছেন; উদয়পুর জয়পুরের কতকগুলি স্কেচ্ করেছেন, লোভ হত দু-একখানির উপর। অনেক সাহেব এদেশের স্কেচ্ করেছে, ছাপিয়েছেও দু-একজন; কিন্তু তাদের স্কেচ্গুলিতে কেমন যেন বিদেশের ছাপ থাকত আর থর্নটনের অ্যালবাম যেন ভারতবর্ষের হুবহু ছবি। মাঝে মাঝে তার ফ্ল্যাটেও যেতুম; তেতলার ফ্ল্যাট, গোল সিঁড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে চাপরাসিকে জিজ্ঞেস করতুম, ‘সাহেব আছেন?’ চাপরাসি উত্তর দিতে না দিতেই ওদিক থেকে ঢিলে ঢালা পাজামা পরে সাহেব এসে উপস্থিত হতেন; তারপর দুজনে বসে কত গল্প, কত হাসি, কত মজাই না করতুম। প্রাণ-খোলা হাসি ছিল তার। তাদের আর্ট ক্লাব ভেঙে গেলে পর, ক্লাবের বোর্ড আলমারি আমাকে তিনি দিয়েছিলেন। বললেন, ‘কী হবে আর এসব দিয়ে, তুমিই নিয়ে যাও, কাজে লাগবে।’
আমাদের আর্ট সোসাইটির উনি একজন বড় উৎসাহী সভ্য ছিলেন। শুধু তাই নয়, বড় খদ্দেরও ছিলেন। নন্দলালের অনেক ছবি উনি কিনেছেন। একবার নন্দলালের ‘সতী’ ছবিখানি কিনেছেন। সে সময়ে আমরা ঠিক করি, ভালো ভালো ছবিগুলি ছাপিয়ে বাজারে ছড়িয়ে দেব। করিয়েও ছিলুম কিছু, খুব ভালো হয়েছিল। তা সেই ‘সতী’ ছবিখানি ও আর খানকয়েক ছবি, ভালো করে প্যাক করে জাপানে পাঠানো হল ছাপাবার জন্য। ওকাকুরা, টাইকান, ওঁরা ব্যবস্থা করে দিলেন। ভালো কোম্পানিতে ছবিগুলি ছাপা হয়ে কিছুকাল বাদে তা ফেরত এল। থর্নটনের ‘সতী’ও এল। তিনি ছবির প্যাক খুলে ছবিটি বের করে দেখেন, ছবি আর চিনতেই পারেন না। খবর পাঠালেন, শিগগির এসো, কাণ্ড হয়ে গেছে, সতী কি রকম বদলে গেছে। সেই আগের সতী আর নেই। তাড়াতাড়ি গেলুম। কি ব্যাপার? গিয়ে দেখি তাই তো, মনে হয় আগুনে পুড়ে সতীর গায়ের রঙ যেন ছাই হয়ে গেছে। রুপো পুরানো হয়ে গেলে যেমন হয় তেমনটি। সাহেব বললেন, ‘এ কেমন হল?’ বললুম, ‘রঙ বিগড়ে গেছে। কেন গেছে তা কি করে বলব বল?’ সাহেব বললেন, ‘এ সারানো যাবে না?’ বললুম, ‘না, এ আর সম্ভব নয়।’ সাহেবের মন খারাপ, তাঁর সতীর এমন দশা হয়ে গেল। তখনকার ছবি আমরাই বেশির ভাগ কিনে রাখতুম। সতীটির উপর আমার খুব লোভ ছিল। সাহেব কিনে নিলে, কি আর করি। বললুম, ‘তুমি যদি এই ছবিটি না রাখ তবে আমায় দিয়ে দাও, তার বদলে অন্য ছবি নাও।’ সাহেব বললেন, ‘তবে তোমার ছবি দিতে হবে আমায়।’ বললুম, তা বেশ। পছন্দ কর কোন্টি নেবে।’ শেষে সাহেব ঔরঙ্গজেব দারার মুণ্ড দেখছেন যে ছবিটি ও আর-একটি ছবি এই দুখানির বদলে সতীটি আমায় ফেরত দিলেন।