জ্যোতিকাকার কাছে রাঁচিতে গেলুম, তখন তো আমি কত বড়, ছেলেপুলে নাতিনাতনি আমার চারদিকে। জ্যোতিকাকামশায় রোজ সকালে টুং টুং করে রিক্শ বাজাতে বাজাতে বেড়িয়ে ফিরতেন। কোলের উপর একটি কেকের বাক্স। রিক্শ থেকে নেমে কেকের বাক্সটি আমার হাতে দিয়ে বলতেন, ‘অবন, তোমার জন্য এনেছি, তুমি খেয়ো।’ ঘর ভরতি নাতিনাতনি, সে সব ফেলে আমার জন্য নিজের হাতে বাজার থেকে কেক কিনে আনলেন। এনে আমার হাতে দিয়ে বারে বারে বললেন, ‘তুমি খেয়ো কিন্তু, তোমার জন্যই এনেছি।’ আমি মহা অপ্রস্তুতে পড়তুম। বলতুম, ‘আপনি কেন কষ্ট করতে গেলেন, চাকরদের বললে তারাই তো এনে দিতে পারত।’ কিন্তু তা হবে না। ছোট ছেলেকে লজেঞ্জুস খেতে যেমন দেয়, অবন কেক খেতে ভালোবাসে, নিজের হাতে এনে দিতে হবে। এমনিই ছোট্টটি করে দেখতেন ওঁরা আমাকে চিরকাল। এখনো এক-একদিন আমি স্বপ্ন দেখি যেন বাবামশায় ফিরে এসেছেন, আর আমি ছোট্ট বালকটি হয়ে গেছি। একেবারে নিশ্চিন্ত। আনন্দে ভরপুর হয়ে যাই স্বপ্নেতে। এ স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি। মা পিসিমারা সব বাড়িতে আছেন, আমিও বড় এই রকমই আছি, ছেলেপুলে সব ঘর ভরতি। বাবামশায় যেন কোথায় গিয়েছিলেন, ফিরে এলেন; বাড়ি একেবারে জমজমাট, সবাই ব্যস্ত। আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছি, যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, বাবামশায় এসেছেন আর কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু বাবা যেন দু-দিন বাদেই চলে যাবেন, একটা বৈরাগ্য ভাব। স্বপ্নে ওরই বেদনা বেজে ওঠে বুকে, ঘুম ভেঙে যায়। আমার বাবা ছিলেন অজাতশত্রু; কি তাঁর মন, কি তাঁর ব্যবহার। তাঁর কাছে যে-কেউ আসত তাদের আর দুঃখ বলে কিছু থাকত না। এমনিই আনন্দময় তার সান্নিধ্য ছিল। জ্যেঠামশায়ের একটা কবিতা মনে পড়ল। তার এক লাইনেই আমার বাবামশায় আর জ্যোতিকাকামশায়ের চরিত্র ফুটে উঠেছে। জ্যেঠামশায় লিখেছিলেন—
ভাতে যেথা সত্যহেম মাতে যথা বীর
গুণজ্যোতি হরে যেথা মনের তিমির।
এ অতি সত্যিকথা। তাদের কাছে এলে মনের সব তিমির দূরে চলে যেত। আনন্দময় করে রাখতেন চারদিক। উৎসব, আনন্দ, প্রাণখোলা হো-হো হাসি, সে যে না শুনেছে বুঝবে না। অমন হাসতেই শুনিনে আর কাউকে। বাবামশায় আর জ্যোতিকাকামশায়ের খুব ভাব ছিল। একসঙ্গে তারা আর্ট স্কুলে ভরতি হয়েছিলেন। আমি যখন আর্ট স্কুলে যাই, সে রেকর্ড খুঁজে বের করি।
বাবামশায়ের মত বন্ধুভাগ্য এ বাড়ির আর কারো ছিল না। রবিকা বন্ধু পেয়েছেন, কিন্তু অবন্ধুও পেয়েছেন ঢের। বাবামশায় দেশ বেড়াতে খুব ভালোবাসতেন। থেকে থেকেই পশ্চিমের দিকে ঘুরে আসতেন। ওঁর খুব প্রিয় জায়গা ছিল অমৃতসর। অমৃতসরে গোল্ডেন টেম্পলের সামনে অনেকক্ষণ অবধি বসে থাকতেন আর মন্দিরে ভোগ দিতেন। অমৃতসরের মন্দিরের সব লোকেরা বাবামশায়কে চিনত, হোটেলের খানসাম বাবুর্চিরা অবধি। একবার বড়দাদারা অমৃতসর যান, যে হোটেলে বাবামশায় থাকতেন সেই হোটেলেই তাঁরা উঠেছেন। হোটেলের এক বুড়ো বাবুর্চি তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, বাবামশায়ের নাম করে যে সেই বাবু কোথায়? তিনি যখন পশ্চিমে ওই রকম ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন আমরা তখন আর কতটুকুই বা, কিন্তু আমাদের কাছে নিয়মমত চিঠি দিতেন। শুধু চিঠি দেওয়া নয় আমাদের চিঠি লেখা শেখাতেন। কি ভাবে লিখতে হবে, কোথায় কি ভুল হল চিঠি লিখে লিখে সব ঠিক করে দিতেন। চিঠি লেখা দস্তুরমত শিক্ষা করতে হয়েছে আমাদের। বাড়িতে এক পণ্ডিত আসত তার কাছেও আমাদের চিঠি লেখার শিক্ষা হত। বাবামশায় আমাদের আবার লিখতেন কার কি চাই জানাতে। একবার তিনি তখন দিল্লি আগ্রার দিকে। সেই হিন্দুমেলাতে যে দিল্লির মিনিয়েচার দেখেছিলুম সেই ছিল আমার মনে। আমি লিখলুম, আমার জন্য আগ্রা দিল্লির ছবি আনতে। বাবামশায় ফিরে এলেন; দাদারা যে যা চেয়েছিলেন, বোধ হয় ভালো ভালো জিনিসই হবে, সবাই সবার ফরমাশমাফিক জিনিস পেলেন। আমার জন্য বের হল একটা কাগজের তাড়া। আমি ভেবেছিলুম যে, হিন্দুমেলায় দিল্লির মিনিয়েচারের মত কিছু একটা হবে। কাগজের তাড়া খুলে দেখি আগ্রা দিল্লির কতকগুলো পট। সাদা কাগজের উপরে যেমন কালিঘাট লক্ষ্ণৌয়ের পট হয় সেই রকম হাতে লেখা আগ্রা দিল্লির ছবি আঁকা। এখন আর সে সব পট পাওয়াই যায় না। সেগুলি থাকলে আজ খুব দামি জিনিস হত। তখন কি আর করি, তা-ই খুলে খুলে দেখলুম, কয়েকদিন বাদে ছিঁড়ে কুটে কোথায় উড়িয়ে দিলুম। জানি কি তখন সে সব জিনিসের মূল্য!
বাবামশায় আমার কথা বলতেন, ‘ওকে আর বিদেশে পাঠাব না। ও আমার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ভারতবর্ষ দেখবে, ভারতবর্ষ জানবে। এদেশটাই ওকে দেখাব ভালো করে।’ তাই হল, বাবামশায় মারা গেলেন, আমার আর বিদেশ যাওয়া হল না, এখনও ভারতবর্ষকেই দেখছি, জানছি। বড় হবার পরে যখন ছবি আঁকা নিয়েই মেতে রইলুম, মার মনে বড় ভাবনা হল যে, এই ছেলেটার লেখাপড়াও হল না বিষয়কর্মও শিখল না, কিছুই হল না। তার পর যখন দিল্লির দরবার থেকে সোনার মেডেল এল, আর্টস্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল হলুম, চারদিকে নাম রটতে লাগল, তখন মা বললেন, ‘আমি ভয় পেয়েছিলুম যে কিছুই তোর হল না। এখন মনে হচ্ছে যে কিছু একটা হলি তবুও।’
সুমধুর স্মৃতি তেমন ছিল না জীবনে। তবে কবির সঙ্গ পেয়েছি, সেই ছিল জীবনের একটা মস্ত সম্পদ। মাও বুঝতেন, বলতেন, ‘রবির সঙ্গে আছিস, বড় নিশ্চিন্ত আমি।’
১১. কর্মজীবন বলে আমার কিছু নেই
কর্মজীবন বলে আমার কিছু নেই, অতি নিষ্কর্মা মানুষ আমি। নিজে হতে চেষ্টা ছিল না কখনো কিছু করবার, এখনো নেই। তবে খাটিয়ে নিলে খাটতে পারি, এই পর্যন্ত। তাই করত, আমায় সবাই খাটিয়ে নিত। বাড়িতে কোনো ক্রিয়াকর্ম হলে সহজে হাত লাগাতুম না কিছুতে। কিন্তু যদি কোনো কাজের ভার পড়ত ঘাড়ে নিঁখুত করে সেই কাজ উদ্ধার করে দিতুম। হ্যাভেল সাহেব বসিয়ে দিলেন আর্ট স্কুলে। ছাত্র ধরে দিলেন সামনে, বললেন, ‘আঁকো, আঁকাও।’ তার মধ্যে আর একটা মানেও ছিল। বলতেন অনেক সময়েই যে, ‘ভালো ঘরের ছেলেরা যদি আর্টের দিকে ঝোঁকে পাবলিকের নজর পড়বে এদিকে। দেশের লোক তোমাদের কথায় বেশি আস্থা রাখবে।’ নেহাত মিছে বলতেন না। নয় তো তখনকার আর্ট স্কুল সম্বন্ধে লোকের ধারণাবদলাত না।