একটি ছোকরা আসত তখন আমার কাছে। সারেঙ্গি বাজাত। প্রফুল্ল ঠাকুরের ছেলের বিয়ে, মহা ধুমধাম বিরাট ব্যাপার, গিয়েছি সেখানে। শুনছি কে এক বাজিয়ে সুরবাহার বাজাবে। খুব বলাবলি হচ্ছে। ভাবছি কে এমন ওস্তাদ বীনকার। সভায় বসেছি, এবারে বাজনা শুরু হবে। দেখি, সেই ছোকরাটি একটি বীণা হাতে এল বাজাতে। চিনতেই পারা যায় না তাকে আর। বললুম, ‘তুমিই বীণা বাজাবে?’ সে বললে, ‘হাঁ হুজুর, একটু একটু শিখেছি।’ বললুম, ‘বেশ, বেশ, বাজাও শুনি।’ মনে পড়ে এতটুকু ছোকরা সারেঙ্গি বাজাত, হঠাৎ দেখি সে এক মস্ত ওস্তাদ, সভায় বাজনা শোনায়। হয়, যে এক কালে কিছুই জানত না, সে একদিন বীণাও বাজাতে পারে। কতই দেখলেম।
আরো শোনে। একবার বাংলা থিয়েটারে গেছি, বুড়ো অমৃত বোস, বড়ো ভালো লোক ছিলেন, পাশে বসে আছেন। আর, মিনার্ভা থিয়েটারে ভালো সিন আঁকত, স্টেজ ডেকোরেশন করত, নামটা তার মনে পড়ছে না, আমিই তাকে রেকমেণ্ড করে দিয়েছিলুম, সেও আছে একপাশে বসে। কি একটা অভিনয় হল। অমৃত বোসকে বললুম, ‘দেখুন মশায়, আপনাদের অ্যাক্টর অ্যাকট্রেসরা সিংহাসনে বসবে, বসতেই জানে না, গড়গড়ার নলে টান দিতে পারে না। একটা স্টুডিয়ো করুন, যেখানে তারা এইসব শিখবে। উঠতে বসতে যারা জানে না, তার ‘প্লে’ করবে কি আবার?’ তিনি বললেন, ‘তা বলেছেন ভালো; এটা করতে হবে এবারে।’ অন্য আর-এক রাত্তিরে স্টার থিয়েটারে কি এক সিনে আর-এক আর্টিস্ট রাজসভার সিন এঁকে পিছনে ঝুলিয়ে দিয়েছে, বৃহৎ সভা, ঘরের থাম আসবাবপত্র কিছুই বাদ রাখেনি আঁকতে। এখন সেই সিনে রাজার সিংহাসন পড়েছে। রাজা বসলেন এসে সিনের পার্সপেক্টিভে যেখানে পাপোশটি রাখা আছে ঠিক সেইখানে একটা চৌকিতে। অতিরিক্ত পার্সপেক্টিভের ফল দেখো ছবিতে। রাজার স্থান হল পাপোশের জায়গায়।
আর একবার এই রকম পার্সপেক্টিভের ধাঁধাঁয় পড়েছিলেম ছাত্রদের নিয়ে। নন্দলালরা তখন ছাত্র। আর্টস্কুলে আমি কাজ করি। রাশিয়া থেকে একটি মেম এল। বললে, ‘বুদ্ধের ছবি আঁকব, ঘর চাই একটা।’ ছবি আঁকবে ঘর চাই, তার কি করি। আর্টস্কুলে এখন তোমার দাদার যেটা ড্রইং রুম সেই ঘরটা ছেড়ে দিলুম। সে ঘরের চাবি চেয়ে নিল, বললে, একলা ঘরের দরজা বন্ধ করে নিশ্চিন্তমনে ছবি আঁকবে। আচ্ছা তাই হোক। মেমটি রোজ আসে, ছবি আঁকে, আমি মাঝে মাঝে যাই। উত্তরদিকের দেয়াল জুড়ে কাগজ সেঁটেছে। কাজের সময় ছাড়া বাদবাকি সময় পরদা টেনে ছবি ঢেকে রাখে। ছাত্রেরা কেউ যেতে পারে না কি হচ্ছে দেখতে। নন্দলাল বললে, ‘কী করে ড্রইং করে দেখতে চাই।’ মেমকে বললুম সে কথা, ‘আমার ছাত্রদের দেখাও একবার, কি করে তুমি ড্রইং কর। সে বললে, ‘আর কয়েকদিন বাদে আমার পেনসিল ড্রইং শেষ হয়ে যাবে, তখন দেখাব।’ কদিন বাদে খবর দিলে, ‘এবারে আসতে পারো।’ নন্দলালদের নিয়ে গেলুম। ছবির পরদা সরিয়ে দিলে। প্রকাণ্ড কাগজে বুদ্ধের সভা আঁকছে—ও মা, পার্সপেক্টিভ এমন করেছে, নিচে থেকে উপরে উঠে সেই কোথায় বুদ্ধদেব বসে আছেন নজরে পড়ে না। এ কি ছবি, এ কি পার্সপেক্টিভ? মেম বললে, ‘কারেক্ট্ পার্সপেক্টিভ হয়েছে।’ নন্দলাল বললে, ‘পার্সপেক্টিভের চূড়ন্ত হয়েছে, কিন্তু চিত্রের কিছু নেই এতে।’ পরে শুনি সেই ছবিই কোন্ এক রাজার কাছে বিক্রি করে অনেক টাকা হাতিয়ে চলে গেছে সে দেশে।
কত সুখদুঃখের মান-অপমানের ধাক্কা খেয়ে খেয়ে আর্টিস্টের মন তৈরি হয়। আমরা সব সৃষ্টিছাড়া; প্রকৃতি মায়ের আদুরে, কোলের কাছাকাছি ছেলে; একটা বুনো ভাব আছে। সবার সঙ্গে মেলে না, সত্যিই তাই। সুখদুঃখ আমাদের বেশি করে বাজে, জীবন উপভোগ করবার ক্ষমতাও আমাদের বেশি। প্রকৃতি আমাদের বেশি করে দিয়েছে সবই। একটু আলো দেখি, ছুটে বেরিয়ে পড়ি। সেটিমেণ্টাল?—ঠিক তা নয়। অবিশ্যি এ কথা বলে অনেকেই আমাদের বেলায়। সেবারে কি হয়েছিল—এই ভাবুকতার জন্য কেমন তাড়া খেয়েছিল দুটো ছেলে। রবিকা বেঁচে, এসেছি এখানে। ভোরবেলা সূর্য ওঠবার আগেই খোয়াইর দিকে ছুটতুম। একদিন ছুটছি, ছুটছি, তালগাছ পেরিয়ে গেলুম, খেজুরগাছ দুটোও পেরিয়ে গেলুম, শরগাছের ঝোপগুলির কাছাকাছি এসেছি—দুটো ছেলে, তারাও বুঝি বেড়াতে বেরিয়েছে, বললে, ‘ফিরে দেখুন কি সুন্দর সূর্য উঠেছে।’ আমি তখন হন হন করে হাঁটছি। দিলুম এক তাড়া মেরে, ‘যাঃ যাঃ, কী সুন্দর সূর্য উঠেছে, তোরা দেখ্গে, আমি বলে হেঁটে হয়রান।’ ফিরে এলুম; দেখি রবিকা বসে আছেন চা আগলে নিয়ে। তাড়াতাড়ি এসে বসলুম টেবিলে। রবিকা বললেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে তুমি। এদিকে আমি চা নিয়ে বসে আছি তোমার জন্যে। নাও, খাও।’ বলে এটা এগিয়ে দেন, ওটা এগিয়ে দেন। রবিকার সামনে বসে খাওয়া, সে কি ব্যাপার জানোই তো। তার পর চায়ের সঙ্গে আমার একটু রুটি চলে শুধু। রবিকা বললেন, ‘একটু গুড় খাও দেখিনি। গুড়টা ভালো জিনিস।’ সকালবেলা গুড়! মহামুশকিল, এদিক ওদিক তাকাই; রবিকা আবার মস্ত একটি কেক এগিয়ে দিলেন, ‘খাও ভালো করে।’ একটা ছুরি দিয়ে একটুকরো কেক কেটে নিয়ে বাকিটা আস্তে আস্তে ঠেলে দিলুম অ্যাণ্ড্রুজের দিকে। অ্যাণ্ড্রুজ দেখি সবটাই শেষ করে দিলেন। বেশ খেতে পারতেন। যাক, সকলের ফাঁড়া তে কাটল। প্রতিমাকে বললুম, ‘প্রতিমা, যে কয়দিন আছি ভোরের চা-টা তোর কাছেই খাইয়ে দিস। কেন আর বারে বারে আমায় সিংহের মুখে ফেলা।’ তার পরদিন থেকে সকালে উঠে তাড়াতাড়ি প্রতিমার কাছে চা খেয়েই বেড়াতে বের হতুম। ফিরে আসতেই রবিকা বলতেন, ‘অবন, চা খেলে না তুমি?’ মাথা চুলকে বলতুম, ‘প্রতিমা খাইয়ে দিয়েছে।’ মুচকে হেসে তিনি বলতেন, ‘ও বুঝেছি।’