ছেলেছোকরারা আঁকে দেখবে—দেয়ালি পট, ঝাড়লণ্ঠন, একটু রঙ রেখা, ভুলে গেল তাতেই। তার পর এল রসের প্রৌঢ়তা, যেমন মোগল আমলের আর্টের মধ্যে দেখি; তাদের রঙ, সাজসজ্জা, সে কি বাহার। তার পর সেই বাহার থেকে পৌঁছল গিয়ে রসের আরো উচু ধাপে আর্ট, তবে এল বাইরের-রঙচঙ-ছুট ছবি সমস্ত, যেন মেঘলা দিনের ছায়া, স্নিগ্ধ, গম্ভীর। আর্টের এই কয়টি সোপান মাড়াতে হবে, তবে হয়তো আর্টিস্ট বলতে পারব নিজেকে।
একবার কেষ্টনগরের এক পুতুলগড়া কারিগর জ্যোতিকার একটা মূর্তি গড়লে। অমন তো সুন্দর চেহারা তাঁর, যেমন রঙ তেমনি মুখের ডৌল—মূর্তি গড়ে তাতে নানা রঙ দিয়ে এনে যখন সামনে ধরলে সে যা বিশ্ৰী কাণ্ড হল, শিশুমনও তা পছন্দ করবে না। মাটির কেষ্টঠাকুরের পুতুল বরং বেশি ভালো তার চেয়ে। পুতুল গড়া সোজা ব্যাপার নয়। তার গায়ে এখানে ওখানে বুঝে একটু আধটু রঙ দেওয়া, চোখের লাইন টানা, একটু ফোঁটা দিয়ে গয়না বোঝানো, এ বড় কঠিন। সত্যি বলব, আমি তো পুতুল নিয়ে এত নাড়াচাড়া করলুম, এখনো সেই জিনিসটি ধরতে পারিনি। একটু ‘টাচ’ দিয়ে দেয় এখানে ওখানে, বড় শক্ত তা ধরা। সেবার পরগণায় যাচ্ছি বোটে, সঙ্গে মনীষী আছে। কোথায় রইল সে এখন এক-একা পড়ে, কি শিখল না-শিখল একবার লড়তে এলে তো বুঝব। তা সেবারে খাল বেয়ে যেতে যেতে দেখি এক নৌকোবোঝাই পুতুল নিয়ে চলেছে এক কারিগর। বললুম, ‘থামা, থামা বোট, ডাক্ ওই পুতুলের নৌকো।’ মাঝিরা বোট থামিয়ে ডাকলে নৌকোর মাঝিকে, নৌকো এসে লাগল আমার বোটের পাশে। নানা রঙবেরঙের খেলনা তার মাঝে দেখি কতকগুলি নীল রঙের মাটির বেড়াল। বড় ভালো লাগল। নীল রঙটা ছাই রঙের জায়গায় ব্যবহার করেছে তারা, ছাই রঙ পায়নি নীলেই কাজ সেরেছে। অনেকগুলো সেই নীল বেড়াল কিনে ছেলেমেয়েদের বিতরণ করলুম। পুতুলের গায়ের ‘টাচ’ বড় চমৎকার। পটও তাই, এই জন্যই আমার পট ভালো লাগে, বড় পাক৷ হাতের লাইন সব তাতে।
হ্যাঁ, মনীষীর লড়াইয়ের কথা বলছিলুম। সেই লড়াইয়ের এক সুন্দর গল্প মনে এল। অনেক কাল আগের কথা। একজন লোক, তাঁর পূর্বপুরুষ ভালো মৃদঙ্গ-বাজিয়ে, নিজেও বাজায় ভালো। সে বলেছিল, মৃদঙ্গ বাজিয়ে আমার সুখ হল না। গণেশ আসত, তার সঙ্গে একহাত পাল্লা দিয়ে বাজাতে পারতুম তবে সুখ হত। গণেশের কাছে হার হলেও তার সুখ, সে শুধু সমানে সমানে পাল্লা দিতে চেয়েছিল। কিছুকাল বাদে তার নাতি এল। বলে, ‘খেতে পাচ্ছিনে।’ বললুম, ‘কেন, এতবড় বাজিয়ের নাতি তুমি, খেতে পাচ্ছ না, সে কি কথা। আচ্ছা, কত হলে তুমি থাকবে আমার কাছে?’ অল্পসল্পই চাইলে। রাখলুম তাকে আমার বাড়িতেই। তখন আমার ভয়ানক বাজনার শখ, এসরাজ বাজাই। শ্যামসুন্দরও আছে। ছেলেটি বললে, ‘আমায় কি করতে হবে?’ বললুম, ‘কিছুই না। সন্ধ্যেবেলা তুমি মৃদঙ্গ বাজাবে, আমি শুনব।’ প্রথমদিন সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় যেমন বসি এই রকম দেয়ালের কাছে চৌকি টেনে বসেছি, সে মৃদঙ্গ বাজাবে। বললে, ‘গান চাই।’ শ্যামসুন্দরকে বললুম, সে আস্তে আস্তে গান ধরলে, আর ছেলেটি বাজালে। কি বাজাল, যেন মেঘের গুরু গুরু শুনতে থাকলেম। মৃদঙ্গ বাজছে, সত্যি যেন আকাশে দুন্দুভি বাজছে। রবিকা লিখে গেছেন, বাদল মেঘে মাদল বাজে। ঠিক তাই, এ বাদ্যযন্ত্র বাজছে, না মেঘ। সেদিন বুঝলুম, তার ঠাকুরদা যে বলেছিল গণেশের সঙ্গে পাল্লা দেবে, তা কেন বলেছিল। রবিকাও আসতেন কোনো-কোনোদিন, বসে মৃদঙ্গ শুনতেন সন্ধ্যেবেলা। শুনে খুব খুশি। বলতেন, ‘অবন, একে হাতছাড়া কোরো না তুমি।’ তাকে সমাজে কাজ দেবার কথা হয়েছিল। কিন্তু সমাজের কর্তারা বললেন, আর-একজন বাজিয়ে আছে এখানে, তাকে সরিয়ে কি করে একে নিই, ইত্যাদি। এই করতে করতে কিছুদিন বাদে দ্বারভাঙ্গার রাজার নজরে পড়ল। বেশি মাইনে দিয়ে আমার কাছ থেকে তাকে লোপাট করে নিয়ে গেল। রবিকা কোথায় গিয়েছিলেন, ফিরে এসে বললেন, ‘অবন, তোমার সেই বাজিয়ে?’ বললুম, ‘চলে গেল রবিকা।’ গুণীর গুণ কি চাপা থাকে? আগুনকে তো চেপে রাখা যায় না। সেই এক শুনেছিলুম মৃদঙ্গ বাজনা। অনেক খোলওয়ালাকে থামাতে হয় গানের সময়ে। এত জোরে তাল বাজায় যে সে-শব্দে গান চাপ পড়ে যায়, ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে তার হাত চেপে ধরি।
এই দেখো, বাজনার কথায় আর-একটা মজার কথা মনে পড়ে গেল। এক বীনকার, নামধাম বলব না, চিনে ফেলবে, বড় ওস্তাদ, খুব নামডাক হয়েছে; লক্ষ্ণৌর নবাব তখন মুচিখোলায় বন্দী হয়ে আছেন, এবারে যাবে তাঁকে বাজনা শোনাতে। নিজে খুব সেজেছেন, চোগাচাপকান পরেছেন, জরির গোল টুপি মাথায়, নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন মস্ত একটা হিন্দুস্থানী উপাধি, অমুকজি বীনকার, বীণাটাকেও জড়িয়েছেন নানা রঙের মখমলের গেলাপে। ইচ্ছে, নবাবকে বীণা শুনিয়ে মুগ্ধ করে বেশ কিছু আদায় করবেন। একদিন সকালে বীণা নিয়ে উপস্থিত মুচিখানায়। খবর গেল, ‘কলকাত্তাসে এক বড় বীনকার আয়া—হুজুরকে দরবারমে।’ খবর পাঠিয়ে বসে আছেন দেওয়ানখানায়। নবাব উঠবেন, হাতমুখ ধোবেন, সে কি কম ব্যাপার? নবাব উঠে হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে পান চিবোতে চিবোতে সটকা মুখে মজলিশে এসে বসে হুকুম করলেন, ‘তেরা বীনকারকো বোলাও।’ নবাবের এত্তালা পেয়ে বীনকার উপরে উঠে নবাবকে সেলাম ঠুকে সামনে কায়দা করে বসে বীণার গেলাপ খুলতে লাগলেন এক-এক করে। এখন, নবাবদের কাছে যার বাজাতে যায় তারা আগে থেকে বীণার তার বেঁধে যায়, গিয়েই বাজনা আরম্ভ করে দেয়। আর বীনকার ওখানে বসেই অনেকক্ষণ ধরে তার বেঁধে সুর ঠিক করে, বীণাটি হাতে নিয়ে যেই না দু বার প্রিং প্রিং করেছেন, নবাব বলে উঠলেন, ‘ব্যস্ করো।’ নবাবী মেজাজ, তাদের ‘ব্যস্’ বলা কি বোঝ তো? বীনকার তক্ষুনি বীণা গুটিয়ে সরতে নবাব বললেন, ‘দেওয়ান, ইস্কো শ’ও রূপেয়া ইনাম দেও। আউর বোলো দোসরা দফে মুচিখানেমে আনেসে উসকো বীন ছিনা জায়েগা।’ নবাব ছেড়ে দাও, আমি নিজেও যে নবাবি করেছি এককালে, নাচ গান বাজনা বাদ রাখিনি কিছু। বলেছি তো সে সব তোমায়। কিন্তু ওদিকটা হল না আমার, তা কি করব। ভিতরে সুর নেই যন্তর বাজিয়ে করব কি? কিন্তু কার হাতে কেমন সুরের পাখি ধরা দেয় কে বলতে পারে।