তারপর কলকাতার প্লেগ এল, ভূমিকম্প এল। তেতলা বাড়ি ছেড়ে গেলুম চৌরঙ্গীতে। সেইখানে গুপু মেনিন্জাইটিস্ রোগে চলে গেল আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে। মা তার ছোট্ট বউকে বুকে নিয়ে কেঁদেছিলেন, ‘আমার সব পুরোনো শোক আজ আবার নতুন করে বুকে বাজল রে।’ ফিরে এলুম আবার সেই দক্ষিণের বারান্দাওয়ালা জোড়াসাঁকোর পারের বাড়িতে।
মস্ত ঝড়খাওয়া জাহাজ যাত্রী নিয়ে ফিরে এসে লাগলো বন্দরে। মার মন খারাপ। কি করে তাঁদের মন শান্ত হয় সকলেরই এই ভাবনা। মা আবার ভাবছেন, আমরা কি করে সান্ত্বনা পাই। দিন যায় এইভাবে। দীনেশবাবু এলেন সে সময়ে, তিনি একদিন এনে উপস্থিত করলেন ক্ষেত্রনাথ চূড়ামণিকে। ঠিক হল রীতিমত ভাগবত কথা শুনব। মাকে বলে বন্দোবস্ত করা গেল। কথকের বেদী পাতা গেল নাচঘরে। কথকঠাকুর বেদী জমিয়ে বসলেন। ছেলে বুড়ো, চাকর দাসী, কর্মচারী, আত্মীয় বন্ধু সবার কাছে খবর রটে গেল—কথকতা হবে। চললো কথকতা মাসের পর মাস। খুব জমিয়ে তুললেন ক্ষেত্রনাথ কথক। যেন তিলেভাণ্ডেশ্বর মহাদেবটি, নধর কালো দেহ। চিকের আড়ালে মা বসে শোনেন গুপুর বিধবা বউকে কোলের কাছে নিয়ে। ক্ষেত্রনাথ কথকের বলার ধরন চমৎকার, গলাও ছিল সুমিষ্ট। দক্ষিণের বারান্দার গায়ে নাচঘরটা তখন অস্তমিতমহিমা গন্ধৰ্বনগরের মত ম্লান শোভা ধারণ করেছে। তারই মধ্যে ক্ষেত্রনাথ কথক মায়ের মনের অবস্থানু্যায়ী এক-একটি কথা ভাগবত থেকে বলে চলেছেন, এই ভাবে গেল প্রায় এক বছর।
তার পর রবিকা একদিন পরগণা থেকে ফিরে এসে বললেন, ‘শিবুৰ্কীর্তনীয়াকে এনে গান শোনাও। ছোটবউঠানের ভালো লাগবে, তোমাদেরও ভালো লাগবে, ওরকম আমি আর শুনিনি।’ রবিকা ডেকে পাঠালেন তাকে, এল শিবুকীর্তনীয়া। সে যা জমালে। কীর্তনীয়া ছিল বটে, কিন্তু সে ছিল সত্যিই আর্টিস্ট। তার ছবি আছে, দাদা এঁকেছিলেন। মোটাসোটা চেহারা, ভাবছি এই চেহারায় কেমন করে সে রাখালবালকদের গোষ্ঠলীলা গাইবে। কিন্তু সে যখন ‘ওহে ওহে’ বলে সুর আরম্ভ ক’রে, ‘আবা আবা’ বলে রাখালবালক হয়ে গান ধরলে, তখন অবাক্। অনেকদিন চলেছিল গান, মাথুর থেকে আরম্ভ করে সমস্ত কৃষ্ণলীলা শুনিয়েছিল সে।
সেই সময় ক্ষেত্রনাথ কথকের ছুটি হয়ে গেল। তিনি বলে গেলেন, ‘রবিবাবু এসে আমার জমাট আসরটা ভেঙে দিলেন।’ আমার কাছ থেকে একটি ছবি তিনি নিয়েছিলেন চেয়ে। তাঁরই বর্ণনামত এঁকেছি পদ্মফুলের উপরে দাঁড়িয়ে বালক কৃষ্ণ। তিনি বলেছিলেন পুজো করবেন। তাঁর সঙ্গে সেই ছবি কাশীতে গেল। তার পর তিনি মারা যাবার পর সে ছবি হাত ফিরতে ফিরতে কোথায় গেল জানিনে। সেদিন দেখি কোন্ এক কাগজে তা ছাপিয়েছে।
তার পর একদিন মাও গেলেন। দাদাও গেলেন জোড়াসাঁকোর বাড়ি শূন্য করে।
ক্ৰমে ক্রমে আমার দক্ষিণ বারান্দার জলসা বন্ধ হল। লক্ষ্ণৌতে গিয়েছিলুম রবিকার সঙ্গে। গোমতীর উপরে বাদশার আমদরবারের ভগ্ন স্তূপে বসে মনে পড়ত আমার দক্ষিণের বারান্দার আড্ডা। তার পর যখন সত্যিই সেই দক্ষিণের বারান্দা প্রায় ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে তখনো মায়া ছাড়তে পারিনি। ভাই বন্ধু সঙ্গী ছাত্র সব চলে গেছে; অতবড় খালি বাড়ির সেই দক্ষিণ বারান্দায় একা বসে আমি পুতুল গড়ি, বৈচিত্র্যহীন জীবনে ওইটুকু বৈচিত্র্য আছে তখনো।
এমন সময়ে একদিন ফেলাবতী এসে হাজির। কোথা থেকে উঠে এলো এতটুকুন মেয়েটি, নেড়া ভোলা চেহারা; বললুম, ‘কে তুই?’
‘আমি ফেলা।’
‘ও, ফেলা, তা এসো।’
দেখে বড় আনন্দ হল। যখন ফেলে-দেওয়া জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি, নতুন রূপ দিচ্ছি, তখন এল ফেলাবতী আমার। বললুম, ‘কোত্থেকে আসিস? ঘর কোথায়?’
বললে, ‘এই এখান থেকেই।’ বলে রাস্তার মোড়ের দিকটা দেখালে।
‘কে আছে তোর?’
‘মা আছে।’
‘কি নাম?’
‘কৌমুদী।’
‘বাপের নাম কি?’
‘বসন্ত।’
ভাবছি, এ কোন্ ফেলা এল। মনে হল না, সে মানুষ।
বললুম, ‘কি চাই তোর?’
‘আমি এখানে বসে খেলা করিনে একটু?’
‘তা বেশ তো, কর্ তুই খেলা। বলি, ফেলা একটা সন্দেশ খাবি?’
‘তা খাব।’
রাধুকে বলি, ‘রাধু, আমার ফেলার জন্যে সন্দেশ নিয়ে আয় একটা।’ সে মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। একটা সন্দেশ আর মাটির গেলাসে জল এনে দেয়। ফেল সন্দেশ খেয়ে জল খেয়ে গেলাসটি এক কোণায় রেখে দেয়।
বলি, ‘কেমন লাগল?’
ফেলা বলে, ‘তোমাদের সন্দেশ কেমন আঠা-আঠা, গলায় লেগে যায়। মা খাওয়ায় কটকটে সন্দেশ, সে আরো ভালো।’
‘তা বেশ।’ এমনি রোজ আসে সে সন্দেশ খাইয়ে ভাবসাব করি। সে একপাশে বসে খেলে, আমিও খেলি। ভাঙা কাঠকুটো নুড়ি দিই। সে বসে তাই দিয়ে খেলা করে। পাশের একটা টেবিলে পুতুল গড়ে গড়ে রাখি।
সে বললে, ‘এগুলোর ধুলো ঝেড়ে রাখি?’
‘তা রাখো।’
সে ধুলো ঝাড়ে, তাতে হাত বোলায়।
‘বলি, পুতুল নিবি একটা?’
‘না, পুতুল দিয়ে কি করব? আমায় নুড়িগুলো বরং দাও।’
‘কি করবি তুই?’
‘ভাইকে দেব, ঘুঁটি খেলাবে।’
কোনোদিন চায় পুরোনো খবরের কাগজ, বাপকে দেবে, বাপ ঠোঙা করে বাজারে বেচবে। কোনোদিন বা চায় পুরোনো টিনের কৌটা, মাকে দেবে, মা মসলাপাতি রাখবে।
এমনি রোজই আসে। হঠাৎ আসে নিঃশব্দে, বুঝতে পারিনে কোথা দিয়ে আসে। বিনিপয়সার খেলুড়ি ফেলা নিঃসঙ্গ দিনের, মানুষের মধ্যেও সে ফেলা, কাঠকুটরো, ছেঁড়া টুকরো কাগজেরই সামিল। যত ফেলা জিনিস কুড়িয়ে বাড়িয়ে এক বুড়ো আর এক মেয়ে খেলা জুড়েছি সেই দক্ষিণের বারান্দায়। একদিন ফেলা বললে, ‘তোমাদের বাড়ির ভিতরটা দেখাবে আমায়?’