মতিবাবু, তার ছবি তো দেখছ, দাদা এঁকেছেন—চেয়ারের উপর পা তুলে বসে বুড়ো হুঁকো খাচ্ছেন। হুঁকো খেয়ে খেয়ে গোঁফ হয়ে গিয়েছিল সোনালি রঙের। সকালে হয় আর্টের কাজ, সন্ধ্যেয় আসর জমাই মতিবাবুকে নিয়ে, গানের চর্চা করি। আমি ম্যাণ্ডোলিন বা এসরাজ বাজাই, তিনি পাঁচালি বা শিবের বিয়ে গেয়ে চলেন। বড় সরেশ লোক ছিলেন। ছেলের বিয়েতে আটচালা বাঁধতে হবে, মতিবাবু ছাড়া আর কেউ সে কাজ পারবে না। শহরের কোথায় কোথায় ঘুরে কাকে কাকে ধরে নকশামাফিক আটচালা বাঁধাবেন একপাশে বসে বুড়ো তামাক টানতে টানতে। এই মতিবাবু মরবার পরও দেখা দিয়েছিলেন, সে এক আশ্চর্য গল্প।
মতিবাবুর একবার দুরন্ত অসুখ। ছেলে এসে বললে, আর বাঁচবেন না। দেশে নিয়ে গেল। খবরাখবর নেই, ভাবছি কি হল তাঁর। অনেকদিন পরে একদিন ফিরে এলেন, দিব্যি ফিটফাট লাল চেহারা নিয়ে। বললুম, ‘এমন সুন্দর চেহারা হল কি করে? মনেই হয় না যে অসুখে ভুগে উঠেছেন।’ তিনি বললেন, ‘না, এবার তো সেরে ওঠবার কথাই ছিল না। অসুখে ভুগছি, ডাক্তার-কবিরাজের ওষুধ খাচ্ছি। কিছুতেই কিছু না। শেষে একদিন গাঁয়ের এক মৌলবী বললে, ঠাকুর, ও ওষুধপত্রে কিছু হবে না। আমার একটি ওষুধ খাবেন? একটু করে সুরুয়া বানিয়ে এনে দেব রোজ। কতদিন যাবৎ ভুগছি, মৌলবীর কথাতেই রাজি হলেম। সেই সুরুয়া খেতে খেতেই দেখুন চেহারা কি রকম বদলে গেল।’ বললুম, ‘ভালোই তো, তা এখনো একটু একটু সুরুয়া চলুক না, তৈরি করে দেবে বাবুর্চি।’ তিনি বললেন, ‘না, আর দরকার হবে না।’ দিব্যি রইলেন সে যাত্রা। তার পর সত্যিই যেবার ডাক পড়ল সেই যে গেলেন আর এলেন না। সেবারেও তিনি অসুখে পড়লেন। বড় ছেলে এসে নিয়ে গেল তাঁকে দেশে, একরকম জোর করেই। অনেকদিন আর কোনো খবর পাইনে, ভাবছি, এবারও বুঝি আগের মতই হঠাৎ একদিন এসে উপস্থিত হবেন। সকালে বসে আছি বারান্দায়, একটা লোক ধীরে ধীরে এসে বাগানে ঢুকল, দেখি মতিবাবু। চাকরদের বললুম, ‘ওরে দেখ্ দেখ্, মতিবাবু আসছেন, তামাক টামাক ঠিক রাখ্।’ চাকররা ছুটে নেমে গেল নিচে, দেখলে কোথাও কেউ নেই। বললুম, ‘আমি নিজের চোখে স্পষ্ট দেখলুম দিনের বেলা, তিনি বাগান দিয়ে হেঁটে দেউড়িতে আসছেন। নিশ্চয়ই তিনি হবেন, খুঁজে দেখ্, যাবেন কোথায় আর।’ কিন্তু তাঁকে আর পাওয়া গেল না খুঁজে। দু-চারদিন বাদে তাঁর ছেলে এসে জানালে মতিবাবুর গঙ্গালাভ হয়েছে। ভাবি, তারও কি এমনি টান ছিল তবে ওই বারান্দার উপর।
দক্ষিণের বারান্দার মায়া, কি বুড়ো কি ছেলে, কেউ ছাড়তে পারেনি। ঈশ্বরবাবু আসতেন, ছেলেবেলায় দ্বারকানাথের আমলের জাহাজের মত প্রকাণ্ড একটা কৌচে বসে তাঁর কাছে সন্ধ্যেবেলায় গল্প শুনেছি সেকালের কর্তাদের। ঠিক সেই জায়গায় তাঁর সেই চৌকি থাকবে, একটু নাড়ালে উস্খুস করতেন। আমরা কোনো কোনো দিন দুষ্টুমি করে সে জায়গা দখল করলে বলতেন, ‘ভাই, আমার জায়গাতে কেন?’ অন্য কোনও চৌকি তার পছন্দ নয়। নিজের চৌকিতে ‘আঃ’ বলে বসে পড়তেন, সে যে কত আরামের ‘আঃ’। আসতে যেতে বাগানের লম্বা ঘাসে পা পুঁছে আসতেন, সেই ছিল তার পাপোশ। সেই ঈশ্বরবাবু অসুখে পড়লেন। আশি বছরে চোখ কাটালেন, চোখ ভালো হল, খবরের কাগজ পড়লেন। একদিন বললেন, ‘জানো ভাই? আমার একটা কষের দাঁত উঠছে।’ কুষ্টি পেরিয়ে গেছে, ভারি ফুর্তি। নবীনবাবুর বাড়িতে পড়ে আছেন। মাঝে মাঝে যাই, তাঁকে দেখে আসি। তিনি বলেন, ‘ভালো আছি, ভাই, এই কালই গিয়ে বসব তোমাদের বারান্দায়।’ শেষ দিনও বলেছিলেন ‘কালই যাব সেখানে’; আর ঈশ্বরবাবুর আসতে হল না।
পূৰ্ণবাবুর মত ঈশ্বরবাবুকে নিয়ে গেল, দেখলুম দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তাঁর বাশের লাঠিটি আমায় দিয়ে গিয়েছিলেন। পুরানো লাঠি, তার মাথায় একটি নুড়ি বসানো, নিজেই শখ করে লাগিয়ে রেখেছিলেন। ছেলেবেলায় নুড়িটি টেনে খুলতে যেতুম, তিনি বলতেন, ‘খুলো না, ভাই, খুলো না। লাঠির ভিতরে একটি ময়ূর আছে, ছিপি খুললেই বেরিয়ে যাবে।’ মুর্শিদাবাদের গেঁটে বাঁশের দরোয়ানি লাঠি, নাটকে দরোয়ান সাজতে হত তাঁকে, তখন ওই লাঠি কাজে লাগত। সেই তিনিই বলেছিলেন, ‘জানো, ভাই? এবাড়িতে দাড়ির প্রচলন এই আমা হতেই।’ সেই লাঠিটি দিয়ে দাদার একটি ছবিতে ফ্রেম করেছিলুম।
নবীনবাবুও ছিলেন বড় মজার লোক। বাজি রেখে চলন্ত মেল-ট্রেন থামিয়ে চাকরি খোয়ালেন। বাতে পঙ্গু হয়ে শুয়ে আছেন; চোর ঘরে ঢুকে সব জিনিসপত্তর নিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, নড়বার শক্তি নেই, চেঁচিয়েই সারা। স্ত্রীর সঙ্গে একটু ঝগড়াঝাঁটি হ’লেই চাকর প্রেমলালকে ডাকতেন, ‘আমার ছুরিটা নিয়ে এসো, গলায় দেব। এ প্রাণ আর রাখব না।’ চাকর বেশ শানানো ছুরি এনে হাজির করলে বলতেন, ‘ওটা কেন? আমার সেই আম-কাটা ভোঁতা ছুরি নিয়ে এসো।’ এমন কত মজার মজার ঘটনা সব। তিনিও একদিন চলে গেলেন।
মার বড় নাতি, দাদার বড় ছেলে গুপুর বিয়ে হল। দক্ষিণের বারান্দা ঝাড়ে লণ্ঠনে আটচালায় মতিবাবু একেবারে গন্ধৰ্বনগর করে সাজিয়ে দিলেন। নাচে গানে থিয়েটারে জমজমাট হয়ে উঠল বারমহল, অন্দরমহল, নাচঘর, বাগান, দক্ষিণের বারান্দা, সারা জোড়াসাঁকোর বাড়িটাই।