তখনকার দিনে গুরুজনদের মান কি দেখতুম। আমদরবার বসেছে, খবর এল, কালীকৃষ্ণ ঠাকুর পাথুরেঘাটা থেকে দেখা করতে আসছেন। শুনে কি ব্যস্ত সবাই। তোল্ তোল্ হুঁকো কলকে সব তোল্, সরা এখান থেকে এসব। বাবামশায় ঢুকলেন ঘরে, পরিষ্কার জামাকাপড় পরে তৈরি। গুরুজন আসছেন, ভালোমানুষ সেজে সবাই অপেক্ষা করতে লাগলেন। ছোট ছেলেদের মত গুরুজনকে ভয় করতেন তাঁরা; গুরুজনরা এলে সমীহ করা, এটা ছিল। কর্তামশায় এসেছিলেন, বলেছি তো সে গল্প—তাড়াহুড়ো, দেউড়ি থেকে উপর পর্যন্ত ঝাড়পোঁছ, যেন বর আসছেন বাড়িতে।
জোড়াসাঁকোর বাড়ির দক্ষিণ বারান্দার আবহাওয়া, এ যে কি জিনিস! সেই আবহাওয়াতেই মানুষ আমরা। এবাড়ির যেমন দক্ষিণের বারান্দা ওবাড়িরও তেমনি দক্ষিণের বারান্দা। পিসিমাদের মুখে শুনতুম ওবাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বিকেলে দাদামশায়ের বৈঠক বসত। যখন-তখন জুঁই আর বেলফুলের সুগন্ধে সমস্ত বাড়ি পাড়া তর্ হয়ে যেত। দাদামশায়ের শখ, বসে বসে ব্যাটারি চালাতেন। জলে টাকা ফেলে দিয়ে তুলতে বলতেন। একবার এক কাবুলিকে ঠকিয়েছিলেন এই করে। জলে টাকা ফেলে ব্যাটারি চার্জ করে দিলেন। কাবুলি টাকা তুলতে চায়, হাত ঘুরে এদিকে ওদিকে বেঁকে যায়, টাকা আর ধরতে পারে না কিছুতেই। তার পর জ্যেঠামশায়ের আমলে তিনি বসলেন সেখানে। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, বড় বড় পণ্ডিত ফিলজফার আসতেন। স্বপ্নপ্রয়াণ পড়া হবে, এ বারান্দা থেকে ছুটলেন বাবামশায়রা সে বারান্দায়। থেকে থেকে জ্যেঠামশায়ের হাসির ধ্বনি পাড়া মাৎ করে দিত। সে হাসির ধুম আমরাও কানে শুনতুম।
তার পর আমাদের আমলে যখন বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বৈঠক বসবার বয়স হল তখন সেকালের যাঁরা ছিলেন, মতিবাবু, অক্ষয়বাবু, ঈশ্বরবাবু, নবীনবাবু— আর দাদামশায়ের বৈঠকের একটি বুড়ো, কি মুখুজ্যে, নামটা মনে আসছে না, তাঁর ছবি আঁকা আছে, চেহারা গান গলার স্বর সব ধরা আছে মনে, নামটা এরি মধ্যে হারিয়ে গেল, তিনি গাইতেন—দাদামশায়ের বৈঠকখানায়, মাঝে মাঝে আমাদেরও গান শোনাতেন, দাদামশায়ের গল্প বলতেন—এই তিন কালের তিন-চারটি বুড়ো নিয়ে আমরা তিন ভাই বৈঠক জমালেম।
সেই দক্ষিণের বারান্দাতেই, ঠিক তেমনি হুঁকো কলকে ফরসি সাজিয়ে বসি। বাবামশায় যেখানে বসতেন সেখানে দাদা বসে ছবি আঁকেন, একটু তফাতে আমি বসি পুবের বড় খিলেনের ধারে, তার পর বসেন সমরদা। আমাদের বৈঠকেও সেইরকম শালওয়ালা আসে, নতুন নতুন বন্ধুবান্ধব আসে। সামনের বাগানে সেই সব গাছ; দাদামশায়ের হাতে পোঁতা নারকেলগাছ, কাঁঠালগাছ, বাবামশায়ের শখের বাগানে সেই ফোয়ারায় জল ছাড়ে, সেই ভাগবত মালী, সব দেখা যায় বারান্দায় বসে। বিকেলে পাথর-বাঁধানো গোল চাতালে বসি, কাঁচের ফরসিতে সেই গোলাপজলে গোলাপপাপড়ি মিশিয়ে তামাক টানি। কাল বদলেও যেন বদলায়নি, তিন পুরুষের আবহাওয়া খানিক খানিক বইছে তখনো দক্ষিণের বারান্দায়। ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধ হবে, সেই বারান্দায় লম্বা ভোজের টেবিল পড়ল, লম্বা উর্দি পরে সেই নবীন বাবুর্চি, সেই বিশ্বেশ্বর হুঁকোবরদার দেখা দিল, সেই সব পুরানো ঝাড়লন্ঠনের বাতি জ্বলল, প্লেট গ্লাস সাজানো হল। তিন পুরুষের সেই সব গানের সুর এসে মেশে আবার নতুন নতুন গানের সঙ্গে, রবিকার গানের সঙ্গে, দ্বিজুবাবুর গানের সঙ্গে।
আরো হলে আমলে যখন আমরা আর্টিস্ট হয়ে উঠেছি, আর্ট সোসাইটির মেম্বর হয়েছি, বড় বড় সাহেবসুবো জজ ম্যাজিস্ট্রেট লাট আসেন বাড়িতে—কমলালেবুর শরবত, পানতামাক, বেলফুলে ভরে যায় সেই দক্ষিণের বারান্দা। বারান্দার পাশের বড় স্টুডিয়োতেই বীনকারের বীণা গভীর রাত্রে থেমে যায় সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে। আবার যখন বাড়িতে কারো বিয়ে, লৌকিকতা পাঠাতে হয়, মেয়েরা থালা সাজিয়ে দেয়, সেই সওগাতের থালায় থালায় ভরে যায় সেই লম্বা বারান্দা।
তোমরা ভাবো, ঘরের ভিতরে স্টুডিয়োতে বসে ছবি আঁকতুম, তা নয়। বারান্দার এক দিকে আমি আর-একদিকে ছাত্ররা বসে যেত। মুসলমান ছাত্র আমার শমিউজমা একদিকে আসন পেতে বসে সারাদিন ছবি আঁকে, সন্ধ্যে হলে মক্কামুখো হয়ে নমাজ পড়ে নেয় ওই বারান্দাতেই। অবারিত দ্বার দক্ষিণের বারান্দায়, সবাই আসছে, বসছে, ছবি আঁকছি, গান চলছে, গল্পও হচ্ছে। এমনি করেই ছবি এঁকে অভ্যস্ত আমি। অবিনাশ পাগলা সেও আসে, কত রকম বুজরুকি দেখাতে লোক আনে। একদিন একটা লোক ফুঁ দিয়ে গোলাপের গন্ধ বাড়িময় ছড়িয়ে চলে গেল। বারান্দা যেন একটা জীবন্ত মিউজিয়াম। নানা চরিত্রের মানুষ দেখতে রাস্তায় বেরতে হত না, তার আপনিই উঠে আসত সেখানে।
পূর্ণ মুখুজ্যে, মাথায় চুল প্রায় ছিল না, চাঁচা ছোলা নাক-মুখের গড়ন। তিনি মারা যাচ্ছেন, মাকে বলে পাঠালেন, ‘মা, আমি গঙ্গাযাত্রা করব।’ মা আমাদের বললেন, ‘বন্দোবস্ত করে দে।’ আমরা বন্দোবস্ত করে দিলুম। মারা গেলে যেভাবে নিয়ে যায় সেইভাবে বাঁশের খাটিয়া এনে তাঁকে তাতে শুইয়ে নিয়ে চলল। তেতলায় থেকে মা’রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, দোতলার বারান্দা থেকে আমরাও দেখছি— বুড়ো খাটিয়ায় শুয়ে সজ্ঞানে চারদিকে তাকাতে তাকাতে চলেছে। উপরে মাকে দেখতে পেয়ে দু হাত জুড়ে প্রণাম জানালেন—ঘাড় নেড়ে ইঙ্গিতে আমাদের জানালে, যাচ্ছি, ভাই সব। সরকার বরকার কাঁধে করে নিয়ে গেল তাকে ‘হরি বোল’ দিতে দিতে। এসবই দক্ষিণের বারান্দা থেকে দেখতুম, যেন বক্সে বসে এক-একটি সিন দেখছি। পরেশনাথের মিছিল গেল, বিয়ের শোভাযাত্রা গেল, আবার পূর্ণ মুখুজ্যেও গেল।