এমনিতরো নাচও দেখেছিলুম সে আর-একবার। নাটােরের ছেলের বিয়ে, নাচগানের বিরাট আয়োজন। কর্ণাট থেকে নামকরা বাইজি আনিয়েছেন। খুব ওস্তাদ নাচিয়ে মেয়েটি। এসেছে তার দিদিমার সঙ্গে। বুড়ী দিদিমা কালকাবিন্দের শিষ্যা। সভায় বসেছে সবাই। বুড়িটির সঙ্গে নাতনিটিও ঢুকলো; বুড়ি পিছনে বসে রইল, মেয়েটি নাচলে। চমৎকার নাচলে, নাচ শেষ হতে চারদিকে বাহবা রব উঠল। আমার কি খেয়াল হল ওই বুড়িটির নাচ দেখব। নাটোর শুনে বললেন, “অবনদা, তোমার এ কি পছন্দ।’ বললুম, ‘তা হোক, শখ হয়েছে বুড়ির নাচ দেখবার। তুমি তাকে বলো, নিশ্চয়ই এই বুড়ি খুব চমৎকার নাচে।’ নাটোর বুড়িকে বলে পাঠালে। বুড়ি প্রথমটায় আপত্তি করলে, সে বুড়ো হয়ে গেছে, সাজসজ্জাও কিছু আনেনি সঙ্গে। বললুম, কোনো দরকার নেই, তুমি বিনা সাজেই নাচো। বুড়ি নাতনিকে নিয়ে ভিতরে গেল—ওদের নিয়ম, সভায় এক নাচিয়ে উপস্থিত থাকলে আর একজন নাচে না। খানিক পরে বুড়ি নাতনির পাঁয়জোর পরে উড়নিটি গায়ে জড়িয়ে সভায় ঢুকল। একজন সারেঙ্গিতে সুর ধরলে। বুড়ি সারেঙ্গির সঙ্গে নাচ আরম্ভ করলে। বলব কি, সে কি নাচ! এমনভাবে মাটিতে পা ফেলল, মনে হল, যেন কার্পেট ছেড়ে দু-তিন আঙুল উপরে হাওয়াতে পা ভেসে চলেছে তার। অদ্ভুত পায়ে চলার কায়দা; আর কি ধীর গতি। জলের উপর দিয়ে হাঁটল কি হাওয়ার উপর দিয়ে বােঝা দায়। বুড়ির বুড়ো মুখ ভুলে গেলুম, নৃত্যের সৌন্দর্য তাকে সুন্দরী করে দেখালে।
আর-একবার ব্লান্ট সাহেব, উডরফ সাহেব, আমরা কয়েকজন দেশী সংগীতের অনুরাগী মিলে মাদ্রাজ থেকে একজন বীনকারকে আনিয়েছিলুম। সপ্তাহে সপ্তাহে রাত নটার পরে আমাদের বাড়িতে সেই বীনকারের বৈঠক বসত। সাহেবসুবাদের জন্য থাকত কমললেবুর শরবত, আইসক্রীম, পান-চুরুটের ব্যবস্থা। রাত্তিরে শহরের গোলমাল যখন থেমে আসত, বাড়ির শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ত, চাকরদের কাজকর্ম সারা হত, চারদিক শান্ত, তখন বীণা উঠত বীনকারের হাতে। কাইজারলিঙও একবার এলেন সেই আসরে। বীনকার বীণা বাজিয়ে চলেছে, পাশে কাইজারলিঙ স্থির হয়ে চোখ বুজে ব’সে, চেয়ে দেখি বাজনা শুনতে শুনতে তার কান গাল লাল টকটকে হয়ে উঠল। স্বরের ঠিক রংটি ধরল সাহেবের মনে। ঝাড়া একটি ঘণ্টা পূর্ণচন্দ্রিকা রাগিণীটি বাজিয়ে বীনকার বীন রাখলে। মজলিস ভেঙে আর কারো মুখে কথা নেই, আস্তে আস্তে সব যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন।
০৮. জোড়াসাঁকোর বাড়ির দোতলা
জোড়াসাঁকোর বাড়ির দোতলার দক্ষিণের বারান্দা—পুরুষানুক্রমে আমাদের আমদরবার, বসবার জায়গা; প্রকাণ্ড বারান্দা, পুব থেকে পশ্চিমে বাড়িসমান লম্বা দৌড়। তারই এক-এক খাটালে এক-একজনের বসবার চৌকি, সে চৌকি নড়াবার জো ছিল না। ঈশ্বরবাবুর এক, নবীনবাবুর এক, ছোটপিসেমশায়ের এক, বড়পিসেমশায়ের এক, নগেনবাবুর এক, কালাচাঁদবাবুর এক, অক্ষয়বাবুর এক, বৈকুণ্ঠবাবুর এক, বাবামশায়ের এক—এমনি সারি সারি চৌকি দুদিকে। এঁরা সকলেই এক-এক চরিত্র, এঁরা অনেকে বাইরের হয়েও একেবারে জোড়াসাঁকোর ঘরের মত ছিলেন। বাবামশায়ের পোষা কাকাতুয়ার পর্যন্ত একটা খাটাল ছিল, দেয়ালে নিজের স্থান দখল করে বসে থাকত, সেও যেন এক সভাসদ্। সকাল-বিকেল আড্ডার জায়গা ছিল ওই বারান্দা, চিরকাল দেখে এসেছি। গুড়গুড়ি ফরসি হুঁকো বৈঠকে সাজিয়ে দিত চাকররা। কাছারির কাজও চলত সেখানে, দেওয়ান আসত, আসত বয়স্য, পারিষদ। গান, খোসগল্প, হাসি কত কী হত। দেখেছি, ঈশ্বরবাবু নবীনবাবু ওঁরা যে যার জায়গায় হুঁকো খাচ্ছেন, বাবামশায় আছেন ইজিচেয়ারে বসে, ড্রইং বোর্ড কোলে প্ল্যান আঁকছেন। বারান্দায় জোড়া জোড়া থাম, তার মাঝে মাঝে বড় বড় খাটাল, পুবধারে একটা বড় খিলেন, পশ্চিমধারে তেমনি আর-একটা সত্তর-আশি ফুট লম্বা, চওড়াও অনেকটা।
ঈশ্বরবাবু আসতেন রোজ সকালে লাঠি ঠকাস ঠকাস করতে করতে। হাতে রুমালে বাঁধা কচি আম, কোনোদিন বা আর কিছু, যা নতুন বাজারে উঠেছে। বাজারে যে ঋতুতে যা কিছু নতুন উঠবে এনে দিতে হবে, এই ছিল তার সঙ্গে বাবামশায়ের কথা।
নিত্য যাঁরা আসতেন আমদরবারে, তাঁদের কথা তো বলেইছি, অন্যরা কেউ এলে তাঁদেরও বসানো হত ওখানেই। আপিস যাবার আগে পর্যন্ত দক্ষিণের বারান্দায় তাঁদের দরবার বসত। তার পর দক্ষিণের বারান্দা খালি—যে যার বাড়ি চলে গেলেন, বাবামশায় উঠে এলেন, বিশ্বেশ্বর ফরসি গুড়গুড়ি তুলে নিলো। আমরা তখন ঢুকতুম সেখানে; নবীনবাবু হয়তো তখনও বসে আছেন, তাঁকে ধরতুম ফ্যান্সি ফেয়ারে নিয়ে যেতে হবে, ইডেন গার্ডেনে বেড়িয়ে আনতে হবে। বাবামশায়ের দরবারে আমাদের দরখাস্ত পেশ করতে হবে, তিনি হুকুম দেবেন তবে যেতে পারব। আমাদের হয়ে নবীনবাবুই সে কাজটা করতেন।
পুজোর সময় দক্ষিণের বারান্দায় কত রকমের ভিড়। চীনেম্যান এল, জুতোর মাপ দিতে হবে। আমাদের ডাক পড়ত তখন দক্ষিণের বারান্দায়। খবরের কাগজ ভাঁজ করে সরু ফিতের মত বানিয়ে চীনেম্যান পায়ের মাপ নিত, এখনও তার আঙুলগুলো দেখতে পাচ্ছি। দরজি এল, ঈশ্বরবাবু হাঁকলেন, ‘ওহে, ওস্তাগর এসেছে, এসো এসো ভাইসব, মাপ দিতে হবে গায়ের।’ ফিতে খুলে দাঁড়িয়ে দরজি, মোটা পেট, গায়ে সাদা জামা, মাথায় গম্বুজের মত টুপি, সে আমাদের পুতুলের মত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাপ নিয়ে ছেড়ে দিতে ঈশ্বরবাবুও উঠে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন, ‘আমারও গায়ের মাপটা নিয়ে নাও, একটা সদ্রী—পুজো আসছে’ বলে বাবামশায়ের দিকে তাকান। বড়বাজারের পাঞ্জাবী শালওয়ালা বসে আছে নানারকম জরির ফুল দেওয়া ছিট, কিংখাবের বস্তা খুলে। বাবামশায়ের পছন্দমত কাপড় কাটা হলে অমনি নবীনবাবু বলতেন, ‘বাবা, আমার নলিনেরও একটা চাপকান হয়ে যাক এই সঙ্গে।’