পলতার বাগানে মাস ছয়েক কেটেছে; বাগান সাজানো হয়েছে। বিনয়িনীর বিয়ের ঠিকঠাক, এবারে জামাইষষ্ঠীর দিন পাত্র দেখা হবে। বাবামশায়ের ইচ্ছে হল বন্ধুবান্ধব সবাইকে বাগানে ডেকে পার্টি দেবেন। আয়োজন শুরু হল, যেখানে যত আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সাহেবসুবো, কেউই বাদ রইল না। কেবল আসতে পারেননি একজন, বলাই সিংহ, বাবামশায়ের ক্লাসফ্রেণ্ড। শেষ বয়েস অবধি তিনি যখনই আসতেন, দুঃখ করতেন, বলতেন, ‘কেন গেলুম না আমি। শেষ দেখা দেখলুম না।’ যাক সে কথা। এখন বিরাট আয়োজন হল। এত লোক আসবে দু-তিন দিন থাকবে বুঝতেই পার ব্যাপার। দিকে দিকে তাঁবু পড়ল। কেক-মিষ্টান্নে, ফুলে-ফলে, আতর-গোলাপে ভরে গেল চারদিক। নাচগানেরও ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা ঘোরাঘুরি করছি অন্দর-মহলে। বাবুর্চি-খানসামা টেবিল ভরে স্যাণ্ডউইচ আইসক্রিম সাজাচ্ছে। ছেলেমানুষ খাবার দেখে লোভ সামলাতে পারিনে। ঘুরে ফিরেই সেখানে যাই। নবীন বাবুর্চি এটা সেটা হাতে তুলে দেয়, বলে, ‘যাও যাও, এখান থেকে সরে পড়।’ চলে আসি, আবার যাই। এমনি করে আমাদের সময় কাটছে। ওদিকে বৈঠকখানায় শুরু হয়েছে পার্টি, নাচ, গান। রবিকা, জ্যেঠামশায় ওঁরাও ছিলেন; রবিকার গান হয়েছিল। প্রথম দিন দেশি রকমের পার্টি হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন হল সাহেবসুবোদের নিয়ে ডিনার পার্টি। আমাদের নীলমাধব ডাক্তারের ছেলে বিলেতফেরত ব্যারিস্টার নন্দ হালদার সাহেব টোস্ট প্রস্তাবের পর গ্লাস শেষ করে বিলিতি কায়দামাফিক পিছন দিকে গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। অমনি সকলেই আরম্ভ করে দিলেন গ্লাস ছুঁড়ে ফেলতে। একবার করে গ্লাস শেষ হয় আর তা পিছনে ছুঁড়ে ফেলছেন ঝন্ন্ন্ শব্দে চারদিক মুখরিত করে। মনে আছে, খানসামারা যখন লাইন করে করে সাজাচ্ছিল কাচের গ্লাস—গোলাপি আভা, খুব দামি। পরদিন সকালে যখন ঝাটপাট শুরু হল গোলাপের পাপড়ির সঙ্গে গোলাপি কাচের টুকরো স্তূপাকার হয়ে বাইরে চলে গেল। দু-তিনদিন পরে পার্টি শেষ হল, বাবামশায় নিজে দাঁড়িয়ে সকলের খোঁজখবর নিয়ে সব ব্যবস্থা করে অতিথি-অভ্যাগত আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলকে হাসিমুখে বিদায় দিলেন। অন্দর-মহলে মা পিসিমা ব্যস্ত আছেন জামাইষষ্টীর তত্ত্ব পাঠাতে।
এমন সময়ে খবর হল বাবামশায়ের অসুখ। এত হৈ-চৈ হতে হতে কেমন একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের ছায়া পড়ল সবার মুখে চোখে চলায় বলায়। পিসেমশাইরা ছুটলেন ওষুধ আনতে, ডাক্তার ডাকতে; নীলমাধববাবু হাঁকছেন, ‘বরফ আন্, বরফ আন্।’ দাসদাসীরা গুজগুজ ফিসফাস করছে এখানে ওখানে। জ্যৈষ্ঠ মাস, ঝড়ের মেঘ উঠল কালো হয়ে, শোঁ-শোঁ বাতাস বইল। ভোরের বেলা পিসীরা আমাদের ঠেলে তুলে দিলে, ‘যা শেষ দেখা দেখে আয়।’ নিয়ে গেল আমাদের বাবামশায়ের ঘরে। বিছানায় তিনি ছট্ফট্ করছেন। পাশ থেকে কে একজন বললেন, ‘ছেলেদের দেখতে চেয়েছিলে। ছেলেরা এসেছে দেখ।’ শুনে বাবামশায় ঘাড় একটু তুলে একবার তাকালেন আমাদের দিকে, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাথা কাত হয়ে পড়ল বালিশে । বড়পিসিমা ছোটপিসিমা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এ কি, এ কি হল! কাল-জ্যৈষ্ঠ এল রে কাল-জ্যৈষ্ঠ।’
সেইদিন থেকে ছেলেবেলাটা যেন ফুরিয়ে গেল।
০৭. তার পর গেল বেশ কিছুকাল
তার পর গেল বেশ কিছুকাল। একদিন বিয়ে হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে জীবনের ধরনধারণ ওঠাবসা সাজগোজ সব বদলে গেল। এখন উলটাে জামা পরে ধুলো পায়ে ছুটোছুটি করবার দিন চলে গেছে। চাকরবাকররা ‘ছোটবাবু মশায়’ বলে ডাকে, দরোয়ানরা ‘ছোট হুজুর’ বলে সেলাম করে। দু-বেলা কাপড় ছাড়া অভ্যেস করতে হল, শিমলের কোঁচানো ধুতি পরে ফিটফাট হয়ে গাড়ি চড়ে বেড়াতে যেতে হল, একটু আধটু আতর ল্যাভেণ্ডার গোলাপও মাখতে হল, তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসতে হল, গুড়গুড়ি টানতে হল, ড্রেসসুট বুট এঁটে থিয়েটার যেতে হল, ডিনার খেতে হল, এককথায় আমাদের বাড়ির ছোটবাবু সাজতে হল।
বাল্যকালটাতে শিশুমন কি সংগ্রহ করলে তা তো বলে চুকেছি অনেকবার অনেক জায়গায়, অনেকের কাছে। যৌবনকালের যেটুকু সঞ্চয় মন-ভোমরা করে গেছে তার একটু একটু স্বাদ ধরে দিয়েছি, এখনো দিয়ে চলেছি হাতের আঁকা ছবির পর ছবিতে। এ কি বোঝো না? পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মত সে সব সুখের দিন গেল। তার স্বাদ পাওনি কি ওই নামের ছবিতে আমার। প্রসাধনের বেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অন্দরমহলে যে সুন্দর মুখ সব, যে ছবি সব সংগ্রহ করলে মন, আমার ‘কনে সাজানো’ ছবিখানিতে তার অনেকখানি পাবে। সুখের স্বপ্ন ভাঙানো যে দাহ সেও সঞ্চিত ছিল মনে অনেকদিন আগে থেকে। সুখের নীড়ে বাসা করেছিলেম, তবেই তো আঁকতে শিখে সে মনের সঞ্চয় ধরেছি ‘সাজাহানের মৃত্যুশয্যা’ ছবিতে।
বাল্যে পুতুল খেলার বয়সের সঞ্চয় এই শেষবয়সের যাত্রাগানে, লেখায়, টুকিটাকি ইঁটকাঠ কুড়িয়ে পুতুল গড়ায় যে ধরে যাচ্ছিনে তা ভেবে না। সেই বাল্যকাল থেকে মন সঞ্চয় করে এসেছে। তখনই যে সে সব সঞ্চয় কাজে লাগাতে পেরেছিলেম তা নয়। ধরা ছিল মনে। কালে কালে সে সঞ্চয় কাজে এল; আমার লেখার কাজে, ছবি আঁকার কাজে, গল্প বলার কাজে, এমনি কত কি কাজে তার ঠিক নেই। এই নিয়মে আমার জীবনযাত্রা চলেছে। আমার সঞ্চয়ী মন। সঞ্চয়ী মনের কাজই এই—সঞ্চয় করে চলা, ভালো মন্দ টুকিটাকি কত কি! কাক যেমন অনেক মূল্যবান জিনিস, ভাঙাচোরা অতি বাজে জিনিসও এক বাসায় ধরে দেয় মন-পাখিটিও আমার ঠিক সেইভাবে সংগ্রহ করে চলে যা-তা। সেই সব সংগ্রহ তুমি হিসেব করে গুছিয়ে লিখতে চাও লেখো, আমি বলে খালাস।