ছেলেবেলায় বাবামশায়ের শখের বাগানে কেউ আমরা ঢুকতে পেতুম না, ভাগবত মালীর দাপটে। আমরা ছেলেরা কয়জনে মিলে একপাশে নিজেদের বাগান বানিয়ে নিয়েছিলুম। ছোট্ট বাগানটি, বাবামশায়ের দেখাদেখি একটা জায়গায় ইঁট পাথর জড়ো করে এখানে ওখানে ঘাসের চাপড়া বসিয়ে পাহাড়ের অনুকরণ করে, মাঝে মাটি খুড়ে একটা গোল মাটির গামলা বসিয়ে তাতে জল ভরে টিনের হাঁস মাছ ছেড়ে চুম্বক কাঠি দিয়ে টানি—সেই হল আমাদের গোলপুকুর। বিকেলে ইস্কুল থেকে সব ছেলে ফিরে এলে তখন আবার সবাই একসঙ্গে হয়ে খেলাধুলো করি। সারাদিন একলা থাকার পর ওই সময়টুকু বড় আনন্দে কাটত আমার।
বিকেল হতেই বাগানে বাবামশায়ের কুরসি ফরসি পড়ে। ভাগবত ফোয়ারা ছেড়ে দেয়; সত্যিকার হাঁস মাছ ফেয়ারার জলে ভেসে বেড়ায়। বাবামশায় নিচে নেমে এসে বসেন বাগানে। পড়শি কালাচাঁদবাবু, মাথায় বুলবুলির ঝুঁটির মত একটু চুল, বুকে একটি ফুল গুঁজে, গলায় চুনটকরা চাদর ঝুলিয়ে, বার্নিশকরা জুতো প’রে, ছিপছিপে ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে হেলেদুলে আসেন বাগানের মজলিসে। ফি শনিবার আপিস ছুটির পর মতিলালবাবু চলে আসেন বাবামশায়ের কাছে। মাছ ধরার খুব ঝোঁক ছিল তাঁর। বাবামশায় বলতেন, ‘এই যে লালমোতি এসেছ, ছিপটিপ ঠিক আছে তো?’ লালমোতি বলেই ডাকতেন তাঁকে। ওদিককার বড় পুকুরে লালমোতি প্রায়ই মাছ ধরতেন। বাবামশায়ও বসে যেতেন মাছ ধরতে কোনো-কোনোদিন। ওই সেই পুরানো পুকুর যার ওপারে প্রকাণ্ড বটগাছ— রবিকার ‘জীবন-স্মৃতিতে’ আছে লেখা। ছেলেবেলায় যা ভয় পেতুম বটগাছটাকে। গল্প শুনতুম চাকরদাসীর কাছে, জটেবুড়ি ব্রহ্মদত্তি কত কি আছে ওখানে।
তা যাক, তখন সেই বিকেলবেলা ওদিকে বাগানে জমত বাবামশায়ের আসর, এদিকে আমাদের হত ইস্কুল-ইস্কুল খেলা। এ-বাড়ি ও-বাড়ির মাঝে যে গলিটুকু কাছারিঘরের সামনে, সেই জায়গাটুকুই আমাদের খেলার জায়গা। কোত্থেকে একটা ভাঙা বেঞ্চি জোগাড় করে তাতে সবকটি ছেলে ঠেসাঠেসি করে বসি, দীপুদা মাস্টার। গলির মোড়ে সেই সময়ে হাঁক দিতে দিতে ভিতরে আসে চিনেবাদাম, গুলাবি রেউড়ি, ঘুগনিদানা, লজেঞ্জুস, কত কি— ‘খায় দায় পাখিটি বনের দিকে আঁখিটি’, বেঞ্চিতে বসে বসে সেই দিকেই নজর আমাদের। কতক্ষণে গুলাবি রেউড়ি চিনেবাদামওয়ালা আসে। দেউড়ির কাছে যেমন তারা এসে দাঁড়ায়, দে ছুট ইস্কুল-ইস্কুল খেলা ছেড়ে। দীপুদা ভাঙা কাঠের চেয়ারে বসে গভীর সুরে বলেন, ‘পড়্ সবাই।’ পড়া আর কি, কোলের উপর ঠোঙা রেখে তা থেকে চিনেবাদাম বের করে ভাঙছি আর খাচ্ছি; দীপুদার হাতেও এক ঠোঙা, তিনিও খাচ্ছেন। এই হত আমাদের পড়া-পড়া খেলা। একদিন আবার প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন হল। কে প্রাইজ দেবে। উপরে বারান্দায় পায়চারি করছেন রবিকা। তিনি আসতেন না বড় আমাদের খেলায় যোগ দিতে। সমান বয়সের ছেলেও তো থাকত এই খেলায়। কিন্তু তিনি ওই তখন থেকেই কেমন একলা একলা থাকতেন, একলা পায়চারি করতেন। সেখান থেকেই মাঝে মাঝে দেখতেন দাঁড়িয়ে, নিচে আমরা খেলা করছি। গিয়ে ধরলুম তাকে, ‘আমাদের ইস্কুলে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন হবে, তোমায় আসতে হবে।’ রবিকা একটু হেসে নেমে এলেন, প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন হল। চিনেবাদাম গুলাবি রেউড়ির ঠোঙা। প্রাইজের পরে আবার তিনি দাঁড়িয়ে বক্তৃতাও দিলেন একটি খুব শুদ্ধভাষায়। আহা, কথাগুলো মনে নেই, নয়তো বড় মজাই পেতে তোমরা।
কালে কালে সেই জোড়াসাঁকোর বাড়ির কত বদলই না হল। আমাদের কালেই সেই তোশাখানা হয়ে গেল ড্রামাটিক ক্লাবের নাট্যশালা। ভিস্তিখানায় টেবিল পড়ত, খাওয়াদাওয়া হত। দপ্তরখানা হল গ্রীনরূম। দেউড়ি তো উঠেই গেল, ভেঙেচুরে লম্বা ঘর উঠল। খামখেয়ালির বৈঠক বসত সেখানে। একবার ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ অভিনয় হল, বাড়ির ছেলেদের দিয়ে করিয়েছিলুম, গাড়িবারান্দায় মনোহর সিঙের দোল-উৎসব হত যেখানে, সেইখানে মস্ত স্টেজ তৈরি হল— ঘোড়াসুদ্ধ গাড়ি সোজা এসে ঢুকল স্টেজে। টং টং করে আপিসফেরত অবিনাশবাবু নামলেন এসে। ব্যাপার দেখে অডিয়েন্স একেবারে অবাক।
কত অভিনয় কত খেলা ক’রে, কত সুখদুঃখের দিন কাটিয়ে, সেই জোড়াসাঁকোর বাড়ি মাড়োয়ারি ধনীকে বেচে বের হতে হল যেদিন আমার নিজের ছেলেপিলে বউঝি নিয়ে, সেদিন সেই তেঁতুলতলায় মেথরের নাতি নাতনি নাতবউ কেবল তারাই এসে আমায় ঘিরে কান্না জুড়লে। তাদের ওইখানেই জন্ম, ওইখানেই মৃত্যু। দেশ ঘর বলে আর কিছু নেই। বলে, ‘এখন উপায় কি হবে বাবু? আমাদের তুলে দিলে কোথায় যাব?’ আমি বলি, ‘চল্ আমার সঙ্গে বরানগরে, সেইখানে তোদের ঘর বেঁধে দেব। তোরা থাকবি, কাজ করবি, যেমন করছিলি এইখানে।’ সেই পুরোনোকালের তেঁতুলতলার মায়া ছাড়তে পারলে না। আজও সেখানে তারা রয়ে গেছে কিনা কে জানে।
কি সুখের স্থানই ছিল, কি সুখের হাওয়াই বইত ওইটুকখানি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। ওখানের মায়ায় যে শুধু আমিই পড়েছিলেম তা নয়, চাকরদাসী কর্মচারী ছেলেবুড়ো সবাই। এই একটি কথা বলি, এ থেকেই বুঝে নাও। মনোরঞ্জনবাবু যশোরের কুটুম্ব; কাছারিতে কাজ করেন, বাতে একটি পা পঙ্গু। তেঁতুলতলায় কর্মচারীদের বাসস্থান, তারই একটি ছোট্ট ঘরে তিনি থাকেন। পেনশন হবে হবে, পড়ল বুড়ো নির্ঘাত রোগে। খবর পেয়ে ছুটি দেখতে বুড়োকে—ছোট্ট ঘর, একটি মাত্র দরজা জাল দেওয়া, দেয়ালে আর কোনো পথ নেই যে হাওয়া রোদ আসে। বুঝলুম বুড়োর দিন ফুরোবে সেইখানেই।