এইবার শোনো রান্নাবাড়ির গল্প। গলির ভিতরে ছোট্ট ঘর, অমৃতদাসী সেই ঘরে বসে জাঁতায় সোনামুগের ডাল ভাঙে আর বাটনা বাটে। এবারে যখন বাড়ি ভাঙে দেখেই চিনলুম—আরে, এই তো সেই অমৃতদাসীর ঘর। ছেলেবেলায় সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিবিষ্টমনে তার ডাল ভাঙা দেখতুম। সোনার বর্ণ সোনামুগের ডাল জাঁতার চারিদিক দিয়ে সোনার ঝরনার মত ঝরে পড়ত। মাঝে মাঝে অমৃতদাসী একমুঠো ডাল হাতে তুলে দিত, বলত, ‘খাবে খোকা? খাও, এই নাও।’ অল্প অল্প করে সেই ডাল মুখে ফেলে চিবতুম, বেশ লাগত। সেই ঘরটি আর জাঁতাটি, সারাজীবন তাই নিয়েই কেটেছে; তার মিউজিক ছিল জাঁতার ঘড়ঘড়নি। সোনামুগ আর বাটনার হলুদের জল ভেসে যাচ্ছে, কাপড়েও লেগেছে, সোনাতে হলুদে মাখামাখি। এখনও মনে হয় তার কথা; দুঃখিনী একটি বুড়ির ছবি চোখে ভাসে।
বাসনমাজানি এল দুপুরে, বাসন মেজে রেখে গেল যার যার দোরে, সোনার মত ঝকঝক করছে। দুধ জ্বাল দেবার দাসী দুধ জ্বাল দিচ্ছে; দুধের ফেনা তুলছে তো তুলছেই। জাল দিয়ে বাটিতে বাটিতে দুধ ভাগ করে রাখছে। তার পর দিব্যঠাকুর হাতা বেড়ি দিয়ে রান্নায় ব্যস্ত। ওদিকটায় আর যেতুম না বড়।
রান্নাবাড়ির ঠিক উপরে ঠাকুরঘর। সেখানে ছোটপিসিমা ব’সে, মহিম কথক কথকতা করছেন, সিংহাসনে ঠাকুর অলকাতিলকা পরে মাথায় রুপোর মুকুট দিয়ে। এখনও সে-সবই আছে, কেবল ছোটপিসিমা নেই, মহিম কথক নেই। সেখানে হত পুরাণের গল্প। সেখান থেকে নেমে এসে ছোটপিসিমার ঘরে ছবি দেখতুম। একটু আগে যা শুনে আসতুম উপরে, নিচে তারই ছবি সব চোখে দেখতুম। সেই পুরাণের পুঁথি কিছু এখনও আছে আমার কাছে, ছেলেরা সেদিন কোন্ কোণা থেকে বের করলে। দেখেই চিনলুম, এ যে মহিম কথকের পুঁথি, এক-একটি পাতা পড়ে যেতেন কথকঠাকুর আর এক-একটি ছবি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠত। লাল বনাত একখানা গায়ে দিয়ে বসতেন পুঁথি পড়তে, হাতে রুপোর আংটি, হাত নেড়ে নেড়ে কথকতা করতেন। রুপোর আংটির ঝক্ঝকানি এখনও দেখতে পাই। আঁকতে শিখে সে ছবি একখানা এঁকেওছিলুম।
বাবামশায়ের সকালের মজলিস বসত দোতলায় দক্ষিণের বারান্দায়। দক্ষিণের বাগানে ভাগবত মালী কাজ করে বেড়াত। বাবামশায়ের শখের বাগানের মালী, নিজের হাতে তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে তৈরি করেছিলেন। যেখানে যত দুর্মূল্য গাছ পাওয়া যায় বাবামশায় তা এনে বাগানে লাগাতেন, বাগান সম্বন্ধে নানারকমের বই পড়ে বাগান করা শিখেছিলেন, ওই ছিল তার প্রধান শখ। কি সুন্দর সাজানো বাগান, গাছের প্রতিটি পাতা যেন ঝকঝক করত। হর্টিকালচারের এক সাহেব বললেন, ‘এদেশে টিউলিপ ফুল ফোটে না, তার অনেক চেষ্টা করে দেখেছেন।’ বাবামশায় বললেন, ‘আচ্ছা, আমি ফোটাব।’ বিলেত থেকে সেই ফুলের গেঁড় আনলেন, নানারকমের সার দিলেন গাছের গোড়ায়; কাচের না কিসের ঢাকা দিলেন উপরে। বাবামশায়ের উদ্ভিদবিদ্যা সম্বন্ধে বড় বড় বই এখনও নিচের তলায় আলমারি ঠাসা। কত বই দেশ বিদেশ থেকে আনিয়ে পড়েছেন। গাছ সম্বন্ধে যে বইটি তিনি সর্বদা পড়তেন, সোনার জলে বাঁধানো, সবুজ চামড়ায় মোড়া, যেন কত মূল্যবান একটি কবিতার বই। বড় হয়ে খুলে দেখি সেটি হারপার কোম্পানির নানারকম ফল ফুল গাছের সচিত্র তালিকা। তা টিউলিপের গেঁড় লাগানো হল, ভাগবত মালীকে শিখিয়ে দিলেন, রোজ তাতে কি করবে, কি করে যত্ন নিতে হবে। তিনিও নিজেও এসে একবার দুবার করে দেখে যান। একদিন সেই ফুল ফুটল—একটি ফুল। ফুল ফুটেছে, ফুল ফুটেছে! ওই একটি ফুলের জন্য বাড়িতে হৈ-চৈ পড়ে গেল। সবাই আসে দেখতে। যে ফুল ফোটে না এই দেশে সেই ফুল ফুটল শেষে। বাবামশায় খুব খুশি । ফুল ফোটাতে শখ হয়েছিল, ফুল ফুটল। হর্টিকালচারের সাহেব খবর শুনে ছুটে এলেন। তিনি অবাক। কত চেষ্টা করেও তাঁরা পারেননি। বললেন, ‘একজিবিশনে দেখাতে হবে।’ শিগগিরই হর্টিকালচারের একজিবিশন হবে। ভাগবত রঙিন চাদর বেঁধে পরিষ্কার ধুতিজামা পরে তৈরি হয়ে এল, তাকে দিয়ে ফুল পাঠানো হল। একজিবিশনে সেই ফুলটির জন্য একটি সোনার মেডেল পেলেন বাবামশায়। সেই সোনার মেডেল আর একটি গাছকাটা কাঁচি ভাগবতকে তিনি বকশিস দিলেন। বললেন, ‘নে মেডেলটা তুইই গলায় ঝোলা।’ মেডেলটা দিয়ে এক সময়ে হয়তো সে ছেলের গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু কাঁচিটি কখনও ছাড়েনি। আমাদের কতবার বলত, ‘বাবুর দেওয়া এই কাঁচি।’
সেদিন বড় মজা লাগল। এই কিছুদিন আগের কথা। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বারান্দায় বসে আছি। ভাগবত মরে গেছে অনেকদিন আগে, তার ছেলে এখন বাগানে কাজ করে। বাগানের কোণায় ছিল করবীগাছ। ছোট ছেলে বাপের হাতের সেই কাঁচি নিয়ে তার ডাল ছাঁটবার চেষ্টা করছে, কিছুতেই আর সামলাতে পারছে না, হাত আগডালে পৌঁছয় না তার। গাছের ডালপাতা হাওয়াতে দুলে দুলে ছেলেটিকে জাপটে ধরছে, কাঁচি হাতে সে তার ভিতরে আটকা প’ড়ে অস্থির। বসে আমি মজা দেখছি আর হাসছি। মোহনলাল শোভনলাল যাচ্ছিল সেখান দিয়ে, তাদের বললুম, ‘ওরে দেখ, মজা দেখ, ভাগবতের ছেলে তার বাপের লাগানো গাছের সঙ্গে কেমন খেলা করছে দেখ। যেন দুষ্টু ছেলের চুল কাটবে নাপিত, ছেলে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে নাপিতকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে। বলে দে ওকে, গাছের ডাল কাটবার দরকার নেই। ও-গাছ অমনি থাকুক।’ বাপের গাছের সঙ্গে ছেলে খেলা করছে দেখে ভারি ভালো লেগেছিল।