সকলে উৎসুক হইয়া শুধাইল–ব্যাপার কি খুলিয়া বলুন।
সাহিত্যিক বলিয়া চলিল—পূর্বদিকের পথ দিয়া গ্রামে গিয়া তো প্রবেশ করিলাম। সে দিকটায় রজকপল্লী। রজকপল্লী দেখিলেই আমার রজকিনী রামীকে মনে পড়িয়া যায়, কোন সাহিত্যিকেরনা যায়? রজক কিশোরীদের লক্ষ্য করিতে করিতে চলিয়াছি—হ্যাঁ—চণ্ডীদাস রসিক ছিল বটে, সজোরে পাথরের উপরে কাপড় আছড়াইবার ফলে দুই বাহু ও সংলগ্ন কোন কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এমন সুপুষ্ট হইয়া ওঠে যে, অপরের প্রশস্ত নীল শাড়িও তাহা আবৃত করিবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বিশেষ কাপড় আছড়াইবার সময় উক্ত প্রত্যঙ্গদ্বয় শরীরের তালে তালে শূন্যে বৃথা মাথা কুটিয়া মরিতে থাকে, তাহা দেখিয়া কোন পুরুষের মন না ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিবে-সাহিত্যিকদের তো কথাই নাই। এমন সময়ে একটি রজক কিশোরী আমাকে দেখিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল—ফিরিয়াছে, ফিরিয়াছে!
ফিরিয়াছে? কে ফিরিয়াছে? হ্যাঁ, ফিরিয়াছে বই কি? আমার মধ্যে দিয়া চিরদিনকার চণ্ডীদাস ফিরিয়া আসিয়াছে—রজকিনী রামীর শীতল পায়ে বুঝিলাম জগতে দুটি মাত্র প্রাণী আছে—আমি চণ্ডীদাস আর কিশোরী রজকিনী রামী দেখিতে দেখিতে আমার চারিদিকে একদল কিশোরী জুটিয়া গেল—জগৎ রামীময়, আর তাহাদের ভাব দেখিয়া মনে হইল জগৎ আমিময়। এ রকম অবস্থায় কবিতা না লিখিয়া উপায় কি?
একজন বলিল—ফিরিয়াছে।
(ফিরিয়াছে বই কি! না ফিরিয়া কি উপায় আছে?)
আর একজন বলিল—অনেকদিন পরে।
(সত্যিই তো! চণ্ডীদাসের পরে আজ কত যুগ গিয়াছে!)
তৃতীয়া বলিল—ঠিক সেই চেহারা, ঠিক সেই হাবভাব।
(এমন তো হইবেই। মানুষ বদলায়, প্রেমিক কবে বদলিয়াছে?)
চতুর্থা বলিল—কেবল যেন একটু রোগা মনে হয়। (ওগো শুধু মনে হওয়া নয়…এ যে অনিবার্য বিরহসঞ্জাত-কৃশতা।)
পঞ্চমী কিছু বলিল না—কেবল আমার গায়ে হাত বুলাইয়া দিল। (ওগো বৈষ্ণব কবি, তুমি প্রশ্ন করিয়াছিলে, অঙ্গের পরশে কিবা হয়। আজ আমারও ঠিক সেই প্রশ্ন)
অপরা বলিল—কিন্তু লেজটা যেন কাটিয়া দিয়াছে?
লেজ? কার লেজ? এবার চণ্ডীদাস-থিওরিতে সন্দেহ জন্মিল।
এবারে আমি প্রথম কথা বলিলাম—আমি প্রেমিক চণ্ডীদাস।
তাহারা সমস্বরে বলিল—হাঁগো হাঁ, তাহার ঐ নামই ছিল বটে।
এই বলিয়া একজন একটা কাপড়ের মোট আনিয়া আমার ঘাড়ে চাপাইয়া দিতে চেষ্টা করিল।
আমি বলিলাম—আমি তো চাকর নই!
তাহারা বলিল—চাকর হইতে যাইবে কেন? তুমি যে গাধা।
আমি গাধা!
বলিলাম—সে কি! আমি যে মানুষের মতো কথা বলিতে পারি।
রসিকা বলিল—অনেক মানুষ গাধার মতো কথা বলে, একটা গাধা না হয় মানুষের মতো কথাই বলিল—আশ্চর্যটা কি?
আমি ব্যস্ত হইয়া বলিলাম—আরে, আরে, আমি যে সাহিত্যিক!
—তবে আর তোমার রাসভত্বে সন্দেহ নাইকারণ যাহারা মধুর স্বাদ নিজে গ্রহণ না করিয়া কবিতার ব্যাখ্যা করিয়া মরে—তাহারা যদি গাধা না তবে গাধা কে?
তখন অপর এক কিশোরী বলিল—ও দিদি, এ যে বশ মানিতে চায় না—কি করি?
কিশোরীর দিদি যুবতী বলিল—প্রেমের ডুরি খানা আন তো?
প্রেমের ডুরি শুনিলেও দেহে রোমাঞ্চ হয়।
দেখিতে পাইলাম একজন মোটা একটি কাছি আনিতেছে।
তবে ওরই নাম প্রেমের ডুরি! ও ডোর ছিড়িবার সাধ্য তো আমার হইবেই না—এমন কি পাড়াসুদ্ধ লোকের হইবে না। তখনই ছুটা কিশোরীরা দৌড়ায় বেশ! প্রায় ধরিয়াছিল আর কি! উঃ, পথ বিপথ লক্ষ্য করি নাই—এই দেখুন হাঁটুর কাছে ছড়িয়া গিয়াছে, কাপড়টা ছিড়িয়া গিয়াছে! তবু ভালো যে প্রেমের ডুরিতে বদ্ধ হই নাই!
এই বলিয়া সে থামিল। তার পরে বলিল—তবু ভালো যে আজ ভিজা মেজেতে শুইতে পাইব, প্রেমের ডোরে বাঁধা পড়িলে গোয়ালে ঘুমাইতে হইত।
তাহার কাহিনী শেষ হইলে সকলে মিলিয়া সিনেমা স্টারের অভিজ্ঞতা শুনিবার জন্য উদগ্রীব হইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল।
চতুর্থ পথিক তাহার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করিতে সুরু করিল।
–বন্ধুগণ, আমি পশ্চিমদিকের পথ দিয়া গ্রামে প্রবেশ করিয়া দেখি একটি পুকুরের ধারে একটি মেলা বসিয়াছে। স্থান কাল পাত্র দেখিয়াই বুঝিতে পারিলাম যে সামাজিক ধাপে আমার। জীবনের মূল্য বিচারের ইহাই যথার্থ স্থানা আমি তখন পুকুরের জলে নামিয়া ডুবিয়া মরিতে চেষ্টা করিলাম। আপনারা ভয় পাইবেন না, সহস্রবার ডুবিয়াও কি করিয়া না মরিতে হয় তাহার কৌশল আমাদের আয়ত্ত। ডুবিয়া মরিবার চেষ্টা অভিনয় মাত্র। আমি সকলকে ডাকিয়া বলিলাম—আমি ডুবিয়া মরিতেছি, তোমরা আমাকে বাঁচাও! আমার আর্ত আহ্বান শুনিয়া সকলে পুকুরের ধারে আসিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু কেহ জলে নামিল না।
আমি বলিলাম—আমি ডুবিলাম বলিয়া—শীঘ্র বাঁচাও!
তাহারা বলিল—আগে তোমার পরিচয় দাও তবে জলে নামিব।
আমি বলিলাম—আমি একজন মানুষ বাঁচাইবার পক্ষে ইহাই কি যথেষ্ট নয়?
তাহারা বলিল—আমরা সবাই তো মানুষ। কেবল আইনে বাধে বলিয়া পরস্পরকে মারিয়া ফেলিতেছি না—সদয় বিধাতা আইনের নিষেধ লঙ্ঘন করিয়া তোমাকে যখন মারিবার ব্যবস্থাই করিয়াছেন—তখন তোমাকে আমরা বাঁচাইতে যাইব কেন?
আমি তাহাদিগকে পরীক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে বলিলাম—আমি শিক্ষক।
তাহারা এক বাক্যে বলিল—জীবন্মত হইয়া বাঁচিয়া থাকিবার চেয়ে তোমার ডুবিয়া মরাই ভালো।
আমি বলিলাম—আমি চিকিৎসক।
তাহারা বলিল—অনেক মারিয়াছ, এবারে মরো।