সে বলিল—কি যে বলো? একটা যেমন তেমন গোরুও আজকাল পাঁচ শশা টাকার কম মেলে না। আর দশটাকা হইলেই একটি শিক্ষক মেলে। এখন তুমিই বিচার করিয়া দেখো।
আমি বলিলাম—কিন্তু আমরা যে জাতিগঠন করি! বৃদ্ধ হাসিয়া বলিল—তার মানে তোমরা গোরু চরাও। কিন্তু রাখালের চেয়ে গোরুর মূল্য অনেক বেশি।
আমি বলিলাম—আপনার ছেলে নিশ্চয় শিক্ষকের কাছে পড়ে!
সে বলিল—পড়িত, এখন পড়ে না। এক সময়ে তাহার জন্য একজন শিক্ষক রাখিয়াছিলাম। সে এখন আমার গোরুর রাখালী করে—কারণ সে দেখিয়াছে যে, শিক্ষকের চেয়ে রাখালের বেতন ও সম্মান অনেক বেশি। তবে তুমি যদি রাখালী করিতে চাও, আমি রাখিতে পারি—আমার আর একজন রাখালের আবশ্যক। আর তোমাকে একটা পরামর্শ দিই, গোরুই যদি চাইবে তবে এমন গোরু চরাও যাহারা দুধ দেয়। দুধ দেয় না এমন মানুষ গোরু চরাইয়া কি লাভ? যাই হোক, তোমার ভালমন্দ তুমি বুঝিবে—তবে বাপু এখানে তোমার জায়গা হইবে না। ইহা শুনিয়া বুঝিতে পারিলাম যে শিক্ষকের জীবনের কি মূল্যা সেখান হইতে সোজা সরাইখানায় ফিরিয়া আসিলাম। এই বলিয়া সে নীরব হইল।
তখন চিকিৎসক তাহার কাহিনী আরম্ভ করিল। সে বলিল—দক্ষিণদিকের পথ দিয়া আমি গ্রামে প্রবেশ করিয়া একটি অট্টালিকা দেখিতে পাইলামা অনুমানে বুঝিলাম বাড়ীটি কোন ধনীর —কিন্তু বাড়ীর মধ্যে ও আশেপাশে লোকজনের উদ্বিগ্ন চলাচল দেখিয়া কেমন যেন সন্দেহ উপস্থিত হইল। এমন সময়ে এক ব্যক্তি বাহিরে আসিতেছিল, তাহাকে শুধাইলাম—মশায়, ব্যাপার কি? এ বাড়ীতে আজ কিসের উদ্বেগ?
সে বলিল—আপনি নিশ্চয় বিদেশী, নতুবা নিশ্চয় জানিতেন তবে শুনুন, এই বলিয়া সে আরম্ভ করিল—এই বাড়ী গ্রামের জমিদারের। তাহার একমাত্র পুত্র মৃত্যুশয্যায়—এখন শেষ মুহূর্ত সমাগত—যাহাকে সাধারণ ভাষায় বলা হইয়া থাকে যমে মানুষে টানাটানি—তাহাই চলিতেছে। বোধ করি যমেরই জয় হইবে।
আমি বলিলাম—এ রকম ক্ষেত্রে যমেরই প্রায় জয় হইয়া থাকে তার কারণ চিকিৎসক আসিয়া যোগ দিতেই যমের টান প্রবলতর হইয়া ওঠে ইহার প্রমাণ দেখিতে পাইবেন যে চিকিৎসক আসিয়া না পৌঁছানো পর্যন্ত রোগী প্রায়ই মরে না। কিন্তু তারপরেই কঠিন।
সে লোকটি বিস্মিত হইয়া কহিল—এ তথ্য আপনি জানিলেন কি করিয়া?
আমি সগর্বে বলিলাম—আমি যে একজন চিকিৎসক।
তখন সে বলিল—আপনার ভাগ্য ভাল, এ গ্রামের চিকিৎসকেরা কেহই রোগীকে নিরাময় করিতে পারে নাই—আপনি গিয়া চেষ্টা করিয়া দেখুন। সফল হইলে প্রচুর ধনরত্ন লাভ করিবেন।
আমি ভাবিলাম, সত্যই আমার ভাগ্য ভালো একবার চেষ্টা করিয়া দেখা যাক। সফল হইলে আর সরাইখানার ভাঙা তক্তপোশে রাত্রি না কাটাইয়া জমিদার-বাড়ীতেই আদরে রাত্রিযাপন করিতে পারিব।
তখন আমি ভিতরে গিয়া নিজেকে চিকিৎসক বলিয়া বিজ্ঞাপিত করিয়া রুগী দেখিতে চাহিলামা আমাকে চিকিৎসক জানিতে পারিয়া জমিদারের নায়েব সসম্রমে বসিতে দিল। সম্যক পরিচয় পাইয়া বলিল—হাঁ, রুগীর অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। তবে আপনি যদি তাহাকে আরোগ্য করিতে পারেন তবে দশ হাজার মুদ্রা ও সরিফপুর পরগণা পাইবেন। আমি উৎফুল্ল হইয়া উঠিলাম। তখন নায়েবের আদেশে একজন ভৃত্য আমাকে ভিতর মহলে লইয়া চলিল। পথে অনেকগুলি ছোট বড় কক্ষ পার হইয়া যাইতে হয়—একটি প্রায়ান্ধকার কক্ষে পাশাপাশি তিন চারটি লোক কাপড় মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছে দেখিতে পাইলাম। চাকরকে জিজ্ঞাসা করিলাম— ইহারা এমন অসময়ে ঘুমাইতেছে কেন?
চাকরটি বলিল—অসময় তাহাতে সন্দেহ নাই কিন্তু তাহাদের এ ঘুম আর ভাঙিবে না।
—সে কি?ইহারা কে?
ইহারা মৃত এবং মৃত চিকিৎসক।
—মরিল কেমন করিয়া?
—চিকিৎসা করিতে গিয়া।
–চিকিৎসায় তো রুগী মরে।
–কখনো কখনো চিকিৎসকও মরে—প্রমাণ সম্মুখেই।
এই সব বাক্য বিনিময়ে আমার চিত্ত উচাটন হইয়া উঠিলা আমি বলিলাম—ব্যাপার কি খুলিয়া বলো।
সে বলিল—বুঝাইবার বিশেষ আবশ্যক আছে কি? হয়তো জীবন দিয়াই আপনাকে বুঝিতে হইবে। জমিদারবাবু বড়ই প্রচণ্ডস্বভাবের লোক। চিকিৎসায় আরোগ্য করিতে পারিলে তিনি চিকিৎসককে প্রচুর ধনরত্ন দিবেন ইহা যেমন সত্য, তেমনি চিকিৎসক ব্যর্থকাম হইলে তাহাকে মারিয়া ফেলিবেন ইহাও তেমনি সত্য প্রমাণ তো নিজেই দেখিলেন।
—আগে আমাকে এ কথা বলা হয় নাই কেন?
—তাহা হইলে কি আর আপনি চেষ্টা করিতে অগ্রসর হইতেন?
—কিন্তু চিকিৎসক মারিয়া ফেলার ইতিহাস তো কখনো শুনি নাই!
জমিদারবাবুর ধারণা আনাড়ি চিকিৎসক যমের দূত। তাহাদের মারিয়া ফেলিলে যমের পক্ষকে দুর্বল করিয়া রুগীর সুবিধা করিয়া দেওয়া হয়। কই আসুন—
আমি ততক্ষণে জানালার শিক ভাঙিয়া, পগার ডিঙাইয়া ছুটিয়াছি—আমাকে ধরিবে কে? যদিচ পিছনে আট-দশটি পাইক পেয়াদা দৌড়াইয়াছে দেখিতে পাইলাম। এক ছুটে সরাইখানায় আসিয়া পৌঁছিয়াছি। এই পর্যন্ত বলিয়া সে থামিল তারপরে বলিল, আজ আমাকে এই স্যাঁতসেতে মেঝেতেই শুইতে হইবে, তা হোক। আমের কাঠের চেয়ে এই ভেজা মেঝে অনেক ভালো।
এবার সাহিত্যিকের পালা। সে বলিল—কি আর বলিব! খুব বাঁচিয়া গিয়াছি বন্ধু চিকিৎসকের মতো আমিও মৃত্যুর খিড়কি দরজার কাছে গিয়া পড়িয়াছিলাম—নেহাৎ পরমায়ুর জোরেই এ যাত্রা রক্ষা পাইয়াছি।