তাহার কাহিনী শুনিয়া অপর তিন পথিক বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল—আপনার পরিচয় কি?
ইহা শুনিয়া চতুর্থ পথিক বলিল—আমি একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা—যাহার বাংলা সিনেমা স্টার।
তখন সকলে একবাক্যে স্বীকার করিল—তাহার অভিজ্ঞতাই সব চেয়ে বিস্ময়কর তবে সিনেমা স্টারের পক্ষে বিস্ময়ের কিছুই নাই।
এই ভাবে পরস্পরের পরিচয় সাধনের পালা উদযাপিত হইতে চারজনে মিলিয়া গল্পগুজব আরম্ভ করিল চারজনেই আশা করিল যে, রাতটা আমোদ-আহ্বাদে ও আরামে কাটাইতে পারিবে এমন সময়ে সরাইখানার মালিক প্রবেশ করিল। সে অতিথিদিগকে বিশেষ আপ্যায়ন করিয়া সেখানে যতদিন খুশী কাটাইতে অনুরোধ করিল, বলিল—তাহাদের যাহাতে কোন অসুবিধা না হয় সেদিকে সে দৃষ্টি রাখিবো তারপরে কি যেন মনে পড়াতে সে একটু হাসিয়া বলিল—এই সরাইখানার সমস্ত ঘরই অধিকৃত কেবল একটিমাত্র ঘর খালি আছে।
পথিকরা বলিল—একটি ঘরেই আমাদের চলিবে।
সরাইখানার মালিক বলিল—ঘরটি নীচের তলাতে, কাজেই একটু স্যাঁৎসেতে—
পথিকরা বলিল—তাহাতেই বা ক্ষতি কি? ঘরে তক্তপোশ আছে তো?
মালিক বলিল—তক্তপোশ অবশ্যই আছে কিন্তু একখানা মাত্র, কাজেই আপনাদের তিনজনকে মেঝেতে শুইতে হইবে, সেই জন্যই স্যাঁতসেতে মেঝের উল্লেখ করিয়াছিলাম। ইহা ছাড়া আর কোন অসুবিধা নাই। আপনাদের মধ্যে কে তক্তপোশে শুইবেন তাহা আপনারা স্থির করিয়া ফেলুন, আমি আর কি বলিব? এই বলিয়া সে প্রস্থান করিল।
তখন পথিক চারজন বিব্রত হইয়া পড়িল কে তক্তপোশে শুইবে আর কারা বা মেঝেতে শুইবে! তাহারা সেই ঘরটায় গিয়া দেখিল সরাইখানার মালিকের কথাই সত্যা ঘরের মেঝে বিষম ভেজা, তার উপরে আবার এখানে সেখানে গর্ত, ইতস্তত অরসুলা, ইঁদুর, ছুঁচো নির্ভয়ে পরিভ্রমণশীল, এক কোণে আবার একটা সাপের খোলসও পড়িয়া আছে। আর এক দিকে একজনের মাপের একখানা তক্তপোশ—সেটাও আবার অত্যন্ত জীর্ণ।
চারজনে গালে হাত দিয়া বসিয়া পড়িল—তাহাদের দুরবস্থা দেখিয়া ছুঁচোগুলো চিকচিক শব্দে পলায়ন করিল—যেন ফিক ফিক করিয়া হাসিয়া উঠিল।
কে তক্তপেপাশে শুইবে? কাহার শরীর খারাপ? চারজনেরই শরীরের অবস্থা সমান।
তখন শিক্ষক বলিয়া উঠিল—এক কাজ করা যাক। আমাদের মধ্যে যাহার জীবন সমাজের পক্ষে সবচেয়ে দরকারী—সে-ই তক্তপোশে শয়ন করিবে, অপর তিনজনকে মেঝেতে শুইতে হইবে।
ইহা শুনিয়া তিনজনে ত্রিগপৎ বলিয়া উঠিল—ইহা অত্যন্ত সমীচীন—আর ইহা শিক্ষকের যোগ্য কথা বটে। কিন্তু কাহার জীবন সমাজের পক্ষে সবচেয়ে দরকারী তাহা কেমন করিয়া বোঝা যাইবে? পরীক্ষার উপায় কি?
তখন সাহিত্যিক বলিল—আমি একটা উপায় নির্দেশ করিতে পারি। আসিবার সময়ে দেখিয়া আসিয়াছি কাছেই একটা গ্রাম আছে। সেখানে আমাদের কেহ চেনে না আমরা চারজন চার পথে সেই গ্রামে প্রবেশ করিবা নিজেদের অত্যন্ত বিপন্ন বলিয়া পরিচয় দিব ইহার ফলে গ্রামের লোকেদের কাছে যে সবচেয়ে বেশি সাহায্য ও সহানুভূতি পাইবে—বুঝিতে পারা যাইবে তাহারই জীবনের মূল্য সর্বাধিক। তক্তপোশে শয়ন করিবার অধিকার তাহারই।
সাহিত্যিকের উদ্ভাবনী শক্তি দেখিয়া তিনজনে স্তম্ভিত হইয়া গেল।
তখন চিকিৎসক বলিল—তবে আর বিলম্ব করিয়া কাজ কি? এখনো অনেকটা বেলা আছে এখনি বাহির হইয়া পড়া যাক, রাত্রি প্রথম প্রহরের মধ্যেই ফিরিতে হইবো
সিনেমা স্টার বলিল—আশা করি, আমরা সকলেই নিজেদের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে ফিরিয়া আসিয়া সত্য কথা বলিব।
ইহা শুনিয়া শিক্ষক বলিয়া উঠিল—হায় হায়, যদি মিথ্যা কথাই বলিতে পারিব তবে আজ কি আমার এমন দুর্দশা হইত!
তখন সকলে পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রামের দিকে বিভিন্ন পথে প্রস্থান করিল।
২.
রাত্রি প্রথম প্রহর উত্তীর্ণ হইবার পূর্বেই চার বন্ধু ফিরিয়া আসিল। সকলে একটু বিশ্রাম করিয়া লইয়া সদ্যলব্ধ অভিজ্ঞতার ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া নিজের নিজের পরিভ্রমণ কাহিনী বলিতে সুরু করিলা
প্রথমে শিক্ষক বলিতে আরম্ভ করিলা সে বলিল—আমি উত্তর দিকের পথ দিয়া গ্রামে প্রবেশ করিলাম কিছুদূর গিয়া একটি সম্পন্ন গৃহস্থ-বাড়ি দেখিলাম—ভাবিলাম এখানেই আমার ভাগ্য পরীক্ষা করিবা বাড়ীর দরজায় উপস্থিত হইবামাত্র সেই দয়ালু গৃহস্থ আমাকে বসিবার জন্য একটি মোড়া আগাইয়া দিল। আমি তাহাকে নমস্কার করিয়া উপবেশন করিলাম। সদাশয় গৃহস্থ আমাকে আপ্যায়িত করিয়া আমার পরিচয় শুধাইল। আমি বলিলাম যে, আমি একজন বিদেশী শিক্ষক—পথ ভুলিয়া এখানে আসিয়া পড়িয়াছি।
ইহা শুনিবামাত্র গৃহস্থ চাকরকে ডাকিয়া বলিল—ওরে রামা, মোড়াটা ঘরে তুলিয়া রাখ, বাহিরে থাকিলে নষ্ট হইয়া যাইবে। আমি পরিত্যক্ত মোড়া হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। বলিলাম—আজ আপনার বাড়ীতে রাত্রি কাটাইবার অনুমতি প্রার্থনা করি। ইহা শুনিয়া গৃহস্থ বলিল—তোমাকে যে আশ্রয় দিব তাহার স্থানাভাবা আমি বলিলাম যে, অন্যজায়গা যদি না থাকে, তবে অন্তত আপনার গোয়ালঘরে নিশ্চয় স্থান হইবে। ইহা শুনিয়া গৃহস্থ বলিল—গোয়ালঘরেই বা স্থান কোথায়? দশ বারোটা গোরু আছে। কোনটাকে বাহিরে রাখিতে সাহস হয় না রাত্রে বাঘের ভয়। আজকাল গোরুর যা দাম, জানো তো?
আমি কহিলাম—গোরুর চেয়ে শিক্ষকের জীবনের মূল্য কম?