- বইয়ের নামঃ প্রমথনাথ বিশীর গল্পসমগ্র
- লেখকের নামঃ প্রমথনাথ বিশী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
চারজন মানুষ ও একখানা তক্তপোশ
একদিন বিকাল-বেলা এক সরাইখানায় চারজন পথিক আসিয়া পৌঁছিল। সরাইখানার মালিক তাহাদের যথাসম্ভব আদর অভ্যর্থনা করিয়া বসাইল। পথিকরা অনেক দূর হইতে আসিতেছে, পথশ্রমে অত্যন্ত ক্লান্ত, গত রাত্রি তাহাদের সকলেরই বৃক্ষতলে কাটিয়াছে, আজ সরাইখানায় বিশ্রাম ও আহার করিতে পারিবে আশায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিলা তাহারা একটি কক্ষে বসিয়া আহার করিয়া লইল এবং তারপরে পরস্পরের পরিচয় লইতে লাগিল। তাহাদের কেহ কাহাকেও চিনিত না—এই তাহাদের প্রথম সাক্ষাৎ।
প্রথম পথিক বলিল যে, সে একজন শিক্ষক। এখন বিদ্যালয়ের ছুটি, তাই সে তীর্থযাত্রায় বাহির হইয়াছিল। হিমালয়ের পাদদেশে পশুপতিনাথের পীঠস্থান কয়েকজন সঙ্গীর সাথে সে সেখানে গিয়াছিল। দেবদর্শন সারিয়া ফিরিবার পথে তাহারা পথ হারাইয়া এক বনের মধ্যে ঢুকিয়া পড়ে। রাত্রে তাহারা এক গাছের তলায় আশ্রয় লইতে বাধ্য হয়। ভোরবেলা যখন সে জাগিল, দেখিল যে তাহাদের সঙ্গীরা নাই, তৎপরিবর্তে তাহাদের কঙ্কাল কয়খানা পড়িয়া আছে। বোধ হয় কোন শ্বাপদে খাইয়া গিয়াছে। কিন্তু সে একা বাঁচিল কিরূপে? তখন তাহার মনে পড়িল সে যে শিক্ষক, সে যে জাতিগঠনের রাজমিস্ত্রি-শ্বাপদ বোধ হয় সেই খাতিরেই তাহাকে ছাড়িয়া দিয়াছে। যদি এ শ্বাপদটা তাহার ভূতপূর্ব ছাত্র হইত, তবে কি আর তাহার রক্ষা ছিল? কিম্বা এমনও হইতে পারে যে হাজার ছাত্র শাসাইয়া এমন শক্তি সে অর্জন করিয়াছে—সামান্য শ্বাপদে তাহার কি করিবে? যাই হোক, আর যে-কারণেই হোক, সে পুনরায় চলিতে আরম্ভ করিলা সারা দিন চলিবার পরে সে এই সরাইখানায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে। সংক্ষেপে ইহাই তাহার পরিচয়।
তখন দ্বিতীয় পথিক আরম্ভ করিল। সে বলিল যে, সে একজন সাহিত্যিক। গোরক্ষপুরে সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় সেখানে সে গিয়াছিল। একটি বৃহৎ অট্টালিকায় যখন মহতী সভার অধিবেশন আরম্ভ হইয়াছে এমন সময়ে এক কালান্তক ভূমিকম্প সুরু হইলা। ফলে অট্টালিকার ছাদখানি পড়িয়া সকলেই মারা গেল—কেবল সে অক্ষতদেহে রক্ষা পাইয়াছে।
তাহার শ্রোতারা বিস্ময়ে বলিল—তাহা কিরূপে সম্ভব?
সাহিত্যিক বলিল, আপনারা জানেন না, আর জানিবেনই বা কিরূপে, আপনারা তো সাহিত্যিক নহেন, সাহিত্যিকদের মাথা বড় শক্ত। হেন ছাদ নাই—খসিয়া পড়িয়া যাহা তাহাদের মাথা ফাটাইতে সমর্থ, হেন ভূমিকম্প নাই যাহাতে তাহারা টলে, হেন অগ্নিকাণ্ড নাই—যাহাতে তাহারা পোড়ে
শিক্ষক বলিল—তবে অন্য সবাই মরিল কেন?
সাহিত্যিক বলিল—সে মহতী সাহিত্য সভায় আমিই ছিলাম একমাত্র সাহিত্যিক। ইহা শুনিয়া আপনারা বিস্মিত হইতেছেন—কিন্তু ইহা নিশ্চয় জানিয়া রাখুন সাহিত্য সভায় পারতপক্ষে সাহিত্যিকরা কখনো যায় না—এক সভাপতি ব্যতীতা তাই তাহারা পিষিয়া মারা গেল—আর আমি যে শুধু বাঁচিয়া রহিলাম তা-ই নয়, আমার মাথায় লাগিয়া একখানা পাথরের টুকরা চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া ধূলি হইয়া গেল। এই সেই ধূলি
এই বলিয়া সে পকেট হইতে এক কৌটা ধূলি বাহির করিয়া দেখাইল। তারপরে বলিল— সাহিত্যিকদের বেলায় শিরোধূলি কথাটাই অধিকতর প্রযোজ্য। তারপরে গোরক্ষপুর হইতে বাহির হইয়া পথ ভুলিয়া এখানে আসিয়াছি। ইহাই আমার পরিচয়
তৃতীয় পথিক বলিল—মহাশয়, আমি একজন চিকিৎসক। হজরতপুরে মহামারী দেখা দিয়াছে শুনিয়া সেখানে আমি গিয়াছিলাম সেখানে কোন চিকিৎসক ছিল না। আমি সেখানে গিয়া নিজেকে বিজ্ঞাপিত করিবামাত্র হজরতপুরের সমস্ত অধিবাসী নগর ছাড়িয়া পলায়ন করিল। তাহারা যাইবার সময়ে বলিয়া গেল যে মহামারীর হাতে যদি বা বাঁচি—মহাবৈদ্যের হাত হইতে রক্ষা করিবে কে?
নগরের মধ্যে ঘুরিতে ঘুরিতে এক অতি কুৎসিত ও বীভৎস বৃদ্ধকে দেখিতে পাইয়া বলিলাম —তুমি পালাও নাই কেন?
সে বলিল—আমার ভয়েই তো সকলে পালাইতেছে, আমি পালাইতে যাইব কেন? আমার নাম মহামারী। আমি তাহাকে বলিলাম যে, তোমার গর্ব বৃথা, সকলে আমার ভয়েই পালাইয়াছে, আমার নাম মহাবৈদ্যা ইহা শুনিবামাত্র সে প্রাণভয়ে পলায়ন সুরু করিলা কিছুকাল পরে দেখি। হজরতপুরের নাগরিকগণ মহামারীর সঙ্গে সন্ধি করিয়া আমার বিরুদ্ধে অভিযান আরম্ভ করিয়াছে। তাহারা বলিল—মহামারী আমাদের শত্রু নয়, মিত্র যেহেতু তাহার কৃপাতেই আমরা অক্ষয়স্বর্গ লাভ করিবার সৌভাগ্য পাইয়া থাকি তাহাদের সম্মিলিত শক্তির সম্মুখে আমি দাঁড়াইতে না পারিয়া পরম ভাগবত ইংরাজ সৈন্যের মতো দৃঢ়পরিকল্পনানুযায়ী পশ্চাদপসরণ করিতে করিতে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। বন্ধুগণ, ইহাই আমার ইতিহাস
তখন চতুর্থ পথিকের পরিচয় দিবার পালা।
সে আরম্ভ করিল—মহাশয়, আমি গঙ্গাস্নানে গিয়াছিলাম। সারা দিন উপবাসী থাকিয়া সন্ধ্যায় যখন স্নান করিতে নামিব এমন সময়ে শুনিতে পাইলাম কে যেন বলিতেছে বৎস, তুমি যথেষ্ট পুণ্য সঞ্চয় করিয়াছ—এখন স্নান করো, করিবামাত্র তোমার মুক্তি হইয়া যাইবে, আর তোমাকে পৃথিবীতে বাস করিতে হইবে না।
সে বলিল—মহাশয়, মুক্তি কাম্য ইহা জানিতাম, কিন্তু কখনো সদ্য মুক্তির সম্ভাবনা ঘটে নাই। আমি বিষম ভীত হইয়া পড়িলাম এবং গঙ্গাস্নান না করিয়াই পলায়ন করিলামা রাত্রে পথ ভুলিয়া গেলাম, কোথা হইতে যে কোথায় গেলাম জানি না—তারপর ঘুরিতে ঘুরিতে এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছি।