৩.
যেসকল যুবক এই যৌবনের সংকেত পাইয়াছিলেন, তাঁরা আজি পর্যন্ত তেমন বুড়া হইতে পারেন নাই। বিদ্যাসাগর প্রভৃতির যৌবন আমরণ পর্যন্ত বাঁচিয়াছিল। কর্মবীর অশ্বিনীকুমার ও সুরসিক মনোরঞ্জন, ইহাদের দেখিয়া বয়সের সঙ্গে যৌবনের কোনও অপরিহার্য সম্বন্ধ আছে, এমন মনে হয় না। এঁরা এখনও যৌবনের জের টানিতেছেন।
–প্রবাহিনী, ৯ শ্রাবণ ১৩২১
এর কোন পাশে আলো আর কোন পাশে ছায়া, তার বিচার পাঠকসমাজই করবেন।
ধ্বনির অপেক্ষা প্রতিধ্বনি যদি বেশি স্পষ্ট হয়, তাহলে অবশ্য পালমহাশয়ের ভাষা আমার ভাষা অপেক্ষা বেশি স্পষ্ট।
আসল কথা, ভাষার বিচার শুধু বাগবিতণ্ডায় পরিণত হয়, যদি-না আমরা ধরতে পারি যে, তথাকথিত সাধুভাষার সঙ্গে তথাকথিত অসাধুভাষার পার্থক্যটি কোথায় এবং কতদূর।
শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ বলেছেন যে, আর-পাঁচজনে যে ভাষায় লেখেন, আমিও সেই একই ভাষায় লিখি; তফাৎ এইটুকু যে, ক্রিয়াপদ এবং সর্বনামের ব্যবহার আমি মৌখিক ভাষার অনুরুপই করে থাকি। চলমহাশয়ের মত আমি শিরোধার্য করি; কেননা, তাঁর একথা সম্পূর্ণ সত্য।
আমি ‘তাহার’ পরিবর্তে ‘তার’ লিখি, অর্থাৎ সাধু সর্বনামের হৃদয়ের হা বাদ দিই। ‘হায় হায়’ বাদ দিলে বাংলায় যে পদ্য হয় না, তা জানি; কিন্তু ‘হা হা’ বাদ দিলে যে গদ্য হয় না, এ ধারণা আমার ছিল না। এবিষয়ে কিন্তু পালমহাশয় আমার সঙ্গে একমত; কেননা, তাঁর লেখাতেও উক্ত ‘হা’ উহ্য থেকে যায়।
শেষটা দাঁড়াল এই যে, পালমহাশয়ের ভাষার সঙ্গে আমার ভাষার যা-কিছু প্রভেদ, তা হচ্ছে ক্রিয়ার বিভক্তিগত। আমি লিখি ‘করে’, তিনি লেখেন ‘করিয়া’। ‘করে’র বদলে ‘করিয়া’ লিখলেই যে ভাষা সমাজিত হয়ে ওঠে, এ বিশ্বাস আমার থাকলে আমি সাহিত্যের সাধুপথ কখনোই ত্যাগ করতুম না। আমার বিশ্বাস, অত শস্তা উপায়ে সুলেখক হওয়া যায় না, কেননা এক স্বরবর্ণের গুণে শব্দের ব্যঞ্জনাশক্তি তাদশ বন্ধিলাভ করে না।
শ্ৰীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁর অভিভাষণে বলেছেন যে, ‘এ এ’ আর ‘ইয়ে ইয়ে’ এ দুয়ের ভিতর ভাষার কোনো প্রভেদ নেই, প্রভেদ যা আছে তা বানানের। একথা যদি সত্য হয়, এবং আমার বিশ্বাস তা সত্য, তাহলে পালমহাশয়ের আমার ভাষার উপর যে আক্রমণ, তা আসলে বানানের উপরে গিয়েই পড়েছে। বানান আমার কাছে চিরদিনই একটি মহা সমস্যা, এবং সে সমস্যার উত্তর-মীমাংসা করা আমার সাধ্যের অতীত। অসাধুভাষার বিপদ যেমন এই বানানের দিকে, সাধুভাষারও বিপদ তেমনি বানানোর দিকে। ও ভাষায় লিখতে বসলে যখন পালমহাশয়ের চাঁচা কলমের মুখ ফসকে ‘আমরণ পর্যন্ত বাঁচিয়াছিল’ এইরূপ বাক্য বেরিয়ে পড়ে, তখন আমাদের কাঁচা কলমের উপর ভরসা কি? এহেন সাধহস্ত হতে মুক্তিলাভ না করলে বঙ্গসরস্বতী ‘আমরণ পর্যন্ত বাঁচিয়া’ নয়, মরিয়াই থাকিবে।
আশ্বিন ১৩২১
খেয়ালখাতা
শ্ৰীমতী ‘ভারতী’সম্পাদিকা নূতন বৎসরের প্রথম দিন হতে ভারতীর জন্য একটি খেয়ালখাতা খুলবেন। এই অভিপ্রায়ে যাঁরা লেখেন কিংবা লিখতে পারেন, কিংবা যাঁদের লেখা উচিত কিংবা লিখতে পারা উচিত— এমন অনেক লোকের কাছে দু-এক কলম লেখার নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। উপরোক্ত চারটি দলের মধ্যে আমি যে ঠিক কোথায় আছি, তা জানি নে। তবও ভারতীসম্পাদিকার সাদর নিমন্ত্রণ রক্ষা করা কর্তব্য বিবেচনায় দুচার ছত্র রচনা করতে উদ্যত হয়েছি। ভারতীসম্পাদিকা ভরসা দিয়েছেন যে, যা-খুশি লিখলেই হবে; কোনো বিশেষ বিষয়ের অবতারণা কিংবা আলোচনা করবার দরকার নেই। এ প্রস্তাবে অপরের কি হয় বলতে পারি নে, আমার তো ভরসার চাইতে ভয় বেশি হয়। আমাদের মন সহজে এবং শিক্ষার গুণে এতটা বৈষয়িক যে, বিষয়ের অবলম্বন ছেড়ে দিলে আমাদের মনের ক্রিয়া বন্ধ হয়, বলবার কথা আর কিছু থাকে না। হাওয়ার উপর চলা যত সহজ, ফাঁকার উপর লেখাও তত সহজ। গণিতশাস্ত্রে যাই হোক, সাহিত্যে শূন্যের উপর শূন্য চাপিয়ে কোনো কথার গুণবৃদ্ধি করা যায় না। বিনিসুতার মালার ফরমাস দেওয়া যত সহজ, গাঁথা তত সহজ নয়। ও বিদ্যের সন্ধান শতেকে অনেক জানে। আসল কথা, আমরা সকলেই গভীর নিদ্রামগ্ন, শুধু কেউ কেউ স্বপ্ন দেখি। ভারতীসম্পাদিকার ইচ্ছা, এই শেষোক্ত দলের একটু বকবার সুবিধে করে দেওয়া।
২.
এ খেয়ালখাতা ভারতীর চাঁদার খাতা। স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে যিনি যা দেবেন, তা সাদরে গ্রহণ করা হবে। আধুলি শিকি দুআনি কিছুই ফেরৎ যাবে না, শুধু ঘষা পয়সা ও মেকি চলবে না। কথা যতই ছোট হোক, খাঁটি হওয়া চাই তার উপর চকচকে হলে তো কথাই নেই। যে ভাব হাজার হাতে ফিরেছে, যার চেহারা বলে জিনিসটে লুপ্তপ্রায় হয়েছে, অতি পরিচিত বলে যা আর-কারও নজরে পড়ে না, সে ভাব এ খেয়ালখাতায় স্থান পাবে না। নিতান্ত পরননা চিন্তা, পুরনো ভাবের প্রকাশের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা আছে–আর্টিকেল লেখা। আমাদের কাজের কথায় যখন কোনো ফল ধরে না, তখন বাজে-কথার ফুলের চাষ করলে হানি কি। যখন আমাদের ক্ষুধানিবৃত্তি করবার কোনো উপায় করতে পারছি নে, তখন দিন থাকতে শখ মিটিয়ে নেবার চেষ্টা করাটা আবশ্যক। আর একথা বলা বাহুল্য, যেখানে কেনাবেচার কোনো সম্বন্ধ নেই ব্যাপারটা হচ্ছে শুধু দান ও গ্রহণের সেস্থলে কোনো ভদ্রসন্তান মসিজীবী হলেও, যেকথা নিজে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন না কিংবা ঝুটো বলে জানেন, তা চালাতে চেষ্টা করবেন না। আমরা কার্যজগতে যখন সাচ্চা হতে পারি নে, তখন আশা করা যায় কল্পনাজগতে অলীকতার চর্চা করব না। এই কারণেই বলছি, ঘষা পয়সা ও মেকি চলবে না।