সংবাদপত্রের সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট থেকে ঠিক বোঝা গেল না যে, আমার ভাষার বিরুদ্ধে পালমহাশয়ের অভিযোগটি কি। আমি পবেই স্বীকার করেছি যে, আমার ভাষা আর-পাঁচজনের ভাষা হতে ঈষৎ পথক। কিন্তু এই স্বাতন্ত্র দোষ বলে গণ্য হতে পারে না। কিং স্বাতন্ত্রম, অবলম্বসে’–এ ধমক সাহিত্যসমাজে কোনো গরজন কোনো ক্ষদ্রজনকে দিতে যে অধিকারী নন, পালমহাশয়ের ন্যায় বিদ্বান ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির নিকট তা কখনোই অবিদিত নেই। তারপর কেউ-কেউ বলেন যে, আমি খাঁটি বাংলার পক্ষপাতী। কোনোরূপ খাঁটি জিনিসের পক্ষপাতী হওয়াই যে দোষ, একথাও বোধ হয় কেউ মুখ ফটে বলবেন না; বিশেষত যখন সে পদার্থ হচ্ছে মাতৃভাষা। মাতৃভাষার শক্তির উপর বিশ্বাস থাকাটাও যে একটা মহাপাতক— একথা আর যেই বলন না কেন, পালমহাশয় কখনো বলতে পারেন না। তবে খাঁটিমাল বলে যদি ভেজাল চালাবার চেষ্টা করি, তাহলে অবশ্য তার জন্য আমার জবাবদিহি আছে। যার সঙ্গে যা মেশানো উচিত নয়, গোপনে তার সঙ্গে তাই মেশালে ভেজাল হয়। ভেজালের মহা দোষ এই যে, তা উদরস্থ করলে মন্দাগ্নি হয়। কিন্তু আমার ভাষা যে, কারও-কারও পক্ষে অগ্নিবর্ধক, তার প্রমাণ এই যে, তা গলাধঃকরণ করামাত্র তাঁরা অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। সে যাই হোক, মণিকাঞ্চনের যোগ সাহিত্যে নিন্দনীয় নয়। সোনার বাংলায় সংস্কৃতের হীরামানিক আমি যদি বসাতে না পেরে থাকি, তাহলে সে আমার অক্ষমতার দরুন; আমি কারিগর নই বলে যে সাহিত্যে জড়াও-কাজ চলবে না, তা হতেই পারে না। খাঁটি সংস্কৃত যে খাঁটি বাংলার সঙ্গে খাপ খায়, সেবিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। বাংলার গায়ে আলগা হয়ে বসে শুধু ইংরেজিভাঙা হাল সংস্কৃত, ওরফে সাধশব্দ। আমার ভাষা নাকি কলকাত্তাই ভাষা। সুতরাং উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম থেকে তা আক্রমণ করা সহজ। অপরপক্ষে সাধুভাষার জন্মস্থান হচ্ছে ফোর্ট উইলিঅমে, সতরাং তাকে আর আক্রমণ করা চলে না–সে যে কেল্লার ভিতরে বসে আছে।
শুনতে পাই যে, পালমহাশয়ের মতে আমার ভাষার প্রধান দোষ এই যে, তা দুর্বোধ। লিখিত ভাষা যে পরিমাণে মৌখিক ভাষার অনুরূপ হয়, সেই পরিমাণে যে তা দুর্বোধ হয়ে ওঠে–এ সত্য আমার জানা ছিল না। শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয় বলেন যে, সাধুভাষা লেখা সহজ। একথা সম্পূর্ণ সত্য। তবে যে আমি সাধুভাষার এই সহজ পথ ত্যাগ করে ‘ভাষামাগে ক্লেশ’ করি, তার কারণ আমার ধারণা যে, বাঙালি পাঠকের কাছে চলিত ভাষা সহজবোধ্য। যে প্রসাদগণের আরাধনা করার দরুন আমি সমালোচকদের প্রসাদে বঞ্চিত হয়েছি, সেই গুণের অভাবই যে ‘অসাধুভাষার প্রথম এবং প্রধান দোষ, একথা আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। অতএব আমার ভাষার যে এ দোষ আছে তা আমি বিনা আপত্তিতে মেনে নিতে পারি নি। তবে যদি পাঠক পড়বার সময় সে ভাষা মনে-মনে ইংরেজিতে তরজমা করে নিতে পারেন না বলে তার অর্থ গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়, তাহলে অবশ্য আমার রচনা দুর্বোধ্য।
লোকে বলে পাঁজি যখন হাতে আছে আছে তখন বারটি মঙ্গল কি শনি সেবিষয়ে তর্ক করার অর্থ শুধু সময় এবং বুদ্ধিবৃত্তির অপব্যয় করা। আমি তাই আমার এবং পালমহাশয়ের লেখার নমুনা পাশাপাশি ধরে দিচ্ছি, পাঠকেরা বিচার করবেন যে, কোন অংশে আমার ভাষা বাদীর ভাষা অপেক্ষা অধিক দুর্বোধ। আমাদের উভয়েরই বক্তব্যবিষয়ের মিল আছে, সুতরাং ভাষার তারতম্য সহজেই চোখে পড়বে।–
‘যৌবনে দাও রাজটিকা’
বীরবল
এদেশে জ্ঞানীব্যক্তিদিগের মতে মনের বসন্তঋতু ও প্রকৃতির যৌবনকাল, দুই অশায়েস্তা, অতএব শাসনযোগ্য।…সেই কারণে জ্ঞানীব্যক্তিরা আমাদের প্রকৃতির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বারণ করেন, এবং নিত্যই আমাদের প্রকৃতির উলটো টান টানতে পরামর্শ দেন; এই কারণেই মানুষের যৌবনকে বসন্তের প্রভাব হতে দূরে রাখা আবশ্যক।… আমাদের বিশ্বাস মানবজীবনে যৌবন একটা মস্ত ফাঁড়া–কোনোরকমে সেটি কাটিয়ে উঠতে পারলেই বাঁচা যায়। এ অবস্থায় কি জ্ঞানী কি অজ্ঞানী সকলেই চান যে, একলম্ফে বাল্য হতে বার্ধক্যে উত্তীর্ণ হন।
২.
মনুষ্যত্ব খর্ব করে মানবসমাজটাকে টবে জিইয়ে রাখায় যে বিশেষ-কিছু, অহংকার করবার আছে, তা আমার মনে হয় না।
৩.
দেহের যৌবনের অন্তে বার্ধক্যের রাজ্যে যৌবনের অধিকার বিস্তার করবার শক্তি আমরা সমাজ হতেই সংগ্রহ করতে পারি।… সমগ্র সমাজের এই জীবনপ্রবাহ যিনি নিজের অন্তরে টেনে নিতে পারবেন, তাঁর মনের যৌবনের আর ক্ষয়ের আশঙ্কা নেই।
–সবুজপত্র, জ্যৈষ্ঠ ১৩২১
যৌবনে কৃষ্ণকথা
শ্ৰীযুক্ত বিপিনচন্দ্র পাল
অক্ষয়বাবু বলিয়াছেন ‘যৌবন বিষম কাল’ কিন্তু চারপাঠ পড়িয়াও আমরা যৌবনের বিষমত্বটা অনুভব করি নাই। আজিকালিকার নবযুবকদিগকে দেখিয়া মনে হয় যেন এদেশ হইতে বসন্তের মতন যৌবনও একরপ চিরবিদায় লইয়াছে।… চক্ষে দেখি তিনটা ঋতু গ্রীষ্ম বর্ষা আর শীত। কিন্তু বসন্তের সাক্ষাৎকার পাওয়া একরূপ অসাধ্য। সেইরূপ এদেশে মানুষের জীবনেও বাল্য প্রৌঢ় ও বার্ধক্য, এই তিন কালই দেখা যায়। বাল্য ফুরাইতে না ফুরাইতে । প্রৌঢ়ত্ব প্রাপ্ত হইয়া থাকে।
২.
টবেতে বড় গাছ জন্মায় না ও বাড়ে না, সেরূপ এক একটা ধর্মের ও নীতির টব সাজাইয়া মানুষগুলোকে তাতে পুঁতিয়া রাখিলে তাদের মনুষ্যত্বও ফুটিয়া উঠিবার অবসর পায় না।