ভবিষ্যতে কি হতে পারে আর না হতে পারে, সেবিষয়ে ত্রিকালজ্ঞ স্বয়ং ভগবান ছাড়া আর কেউ কিছু বলতে পারেন না। সুতরাং দর-ভবিষ্যতে যে ঐ আদর্শ-চাঁদ ভারতবাসীর হাতে আসবে না এবং তাদের মাথায় ঐ আকাশকুসুমের পপটি হবে না–একথা জোর করে কে বলতে পারে। তবে এখন ঐ চাঁদকে ডেকে ‘আয় আয় আমাদের মাথায় টী দিয়ে যা, আর ঐ আকাশকুমকে ডেকে যেখানে আছ সেখানেই থাকো, দেখো যেন ঝরে আমাদের গায়ে পড়ো না’–একথা বলা ছাড়া আমাদের উপায়ান্তর নেই। কেননা, বেশি আলোয় আমাদের চোখ ঝলসে যায়, আর আমরা ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাই।
তবে কথা হচ্ছে এই যে, বর্তমানকে আমরা একেবারেই উপেক্ষা করতে পারি নে, কেননা এ পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যা সম্বন্ধ তা বর্তমানেরই সম্বন্ধ। ‘চোখ বুজলেই অন্ধকার’–এ প্রবাদ তো সকলেই জানেন। সুতরাং আমাদের খোলা-চোখের জন্যও একটা আদর্শ থাকা দরকার। আমরা চাই সেই ফল, যার দ্বারা মা’র নিত্যপজা চলবে; আর সেই চাঁদ, যার আলোতে আমরা রাত্তিরে পথ দেখতে পাব। বলা বাহুল্য যে, এদেশে এখন রাত্তির, আর আমরা জাতকে-জাত রাত-কানা।।
অতএব কগ্রেসের পক্ষে জাতীয়-রাজনৈতিক-শিক্ষা-পরিষদ, হবার পূর্বে জাতীয়-রাজনৈতিক-আদর্শ-অনুসন্ধান-সমিতি হওয়া কর্তব্য।
ইতিমধ্যে আমি একটি আটপৌরে আদর্শ দেশের হাতে ধরে দিতে চাই। আমার কথা এই–এস, আমরা ঘরে বসে নিজের নিজের চরকায় বিলেতি তেল দিই, তাহলেই সকলে মিলে ভারতমাতার চরকায় স্বদেশী তেল দেওয়া হবে এবং তাতে মা আমাদের যে কাটনা কাটবেন, তার সততা মাকড়সার সুতোর চাইতে সূক্ষ্ণ হবে এবং সেই সুতোর জাল বুনে সেই ফাঁদে আমরা আকাশের চাঁদ ধরব।
ফাগুন ১৩২২
কৈফিয়ত
সম্প্রতি বঙ্গসাহিত্যের ছোট বড় মাঝারি সকলরকম সমালোচক আমার ভাষার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করছেন। সে প্রতিবাদে নানাজাতীয় নানা পত্র মুখরিত হয়ে উঠেছে। সে মরমর-ধনি শুনে আমি ভীত হলেও চমকিত হই নি; কেননা, আমি যখন বাংলা লেখায় দেশের পথ ধরে চলছি তখন অবশ্য সাহিত্যের রাজপথ ত্যাগ করেছি। যথভ্রষ্ট লেখককে সাহিত্যের দলপতিরা যে ভ্রষ্ট বলবেন, এতে আর আশ্চর্য কি। বিশেষত সে রাজপথ যখন শুধু পাকা নয়–সংস্কৃতভাঙা শরকি বিলেতি-মাটি এবং চুন দিয়ে একেবারে শানবাঁধানো রাস্তা। অনেকের বিশ্বাস যে, সাহিত্যের এই সদর-রাস্তাই হচ্ছে একমাত্র সাধু পথ, বাদবাকি সব গ্রাম্য। তবে জিজ্ঞাস্যবিষয় এইটকু যে, এই গ্রাম্যতার অপবাদ আমার ভাষার প্রতি সম্প্রতি দেওয়া হচ্ছে কেন। আমি প্রবীণ লেখক না হলেও নবীন লেখক নই। আমি বহনকাল ধরে বাংলা কালিতেই লিখে আসছি। সে কালির ছাপ আমার লেখার গায়ে চিরদিনই রয়েছে। আমার রচনার যে ভঙ্গিটি সহদয় পাঠক এবং সমজদার সমালোচকেরা এতদিন হয় নেকনজরে দেখে এসেছেন, নয় তার উপর চোখ দেন নি—আজ কেন সকলে তার উপর চোখ-লাল করছেন। এর কারণ আমি প্রথমে বুঝে উঠতে পারি নি।
এখন শুনছি, সে, ভাষার নবাবিষ্কৃত দোষ এই যে তা ‘সবুজপত্রের ভাষা’। সবুজের, তা দোষই বল আর গণই বল, একটি বিশেষ ধর্ম আছে। ইংরেজেরা বলেন, যে চোখে সে রঙের আলো পড়ে, সে চোখের কাছে অপরের কোনো দোষই ছাপা থাকে না। আমাদের দোষ যাই হোক, তা যে গুণীসমাজে মারাত্মক বলে বিবেচিত হয়েছে, তার প্রমাণ এই যে, পরিষত্মন্দিরে স্বয়ং বিপিনচন্দ্র পাল মহাশয় ‘সবুজপত্রের ভাষার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছিলেন’। এ সংবাদ শুনে উক্ত পত্রের সম্পাদকের নিশ্চয়ই হরিষে-বিষাদ উপস্থিত হয়েছে। পালমহাশয়ের ন্যায় খ্যাতনামা ব্যক্তি যার লেখা আলোচনার যোগ্য মনে করেন, তার কলম-ধরা সার্থক; কেননা, এতেই প্রমাণ হয় যে, তার লেখায় প্রাণ আছে। যা মত, একমাত্র তাই নিন্দা-প্রশংসার বহির্ভূত। অপরপক্ষে বিষন্ন হবার কারণ এই যে, যেষাং পক্ষে জনাদন’ সেই পাণ্ডুপুত্রদের জয় এবং সবুজপত্রের পরাজয়ও অবশ্যম্ভাবী।
পালমহাশয় যে সবপত্রের ভাষার উপর আক্রমণ করেছেন, এ রিপোর্ট নিশ্চয়ই ভুল : কেননা, ও-পত্রের কোনো বিশেষ ভাষা নেই। উক্ত পত্রের ভিন্ন ভিন্ন লেখকদের রচনার পদ্ধতি ও রীতি সবই পথক। পদের নির্বাচন ও তার বিন্যাস প্রতি লেখক নিজের রুচি অনুসারেই করে থাকেন। কাল যখন কলি, তখন লেখবার কলও নিশ্চয় রচিত হবে; কিন্তু ইতিমধ্যে সবুজপত্রের সম্পাদক যে সে-কলের সন্ধানলাভ করেছেন, এমন তো মনে হয় না। সকলের মনোভাব আর-কিছু একই ভাষার ছাঁচে ঢালাই করা যেতে পারে না। মানুষের জীবনের ও মনের ছাঁচ তৈয়ারি করা যাঁদের ব্যাবসা, তাঁরা অবশ্য একথা স্বীকার করবেন না; তাহলেও কথাটি সত্য। সংগচ্ছদ্ধং এই বৈদিক বিধির কর্মজীবনে যথেষ্ট সার্থকতা আছে। কিন্তু ‘সংবদধ্বং’ এই বিধির সাহিত্যে বিশেষ-কোনো সার্থকতা নেই। এই কারণেই সাহিত্যের প্রতি-লেখককেই তাঁর নিজের মনোভাব নিজের মনোমত ভাষায় প্রকাশ করবার স্বাধীনতা দেওয়া আবশ্যক। ‘সবুজপত্রে লেখকদের সে স্বাধীনতা যে আছে, তা উদাহরণের সাহায্যে দেখানো যেতে পারে। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, সবুজপত্রের নয়, আমার ভাষার উপরেই পালমহাশয় আক্রমণ করেছেন। আমার ভাষার রোগ মারাত্মক হতে পারে, কিন্তু তা সংক্রামক নয়। এক সবুজপত্রের সম্পাদক ব্যতীত আর-কেউই আমার পথানসেরণ কিংবা পদানকরণ করেন না। পালমহাশয় বঙ্গসাহিত্যের সর্বোচ্চ আদালতে আমার ভাষার বিরদ্ধে যে নালিশ রজ করেছেন, সম্ভবত তার একতরফা ডিক্রি হয়ে গেছে; কেননা, সে সময়ে আমি সেক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলাম না। উপস্থিত থাকলে যে মামলা ডিসমিস, করিয়ে নিতে পারতুম, তা নয়। পালমহাশয় বাক্যজগতে মহাবলী এবং মহাবলিয়ে। আমার এতাদশ বাকপটতা নেই যে, আমি তাঁর সঙ্গে বাগযুদ্ধে প্রবত্ত হতে সাহসী হই। আরজি যদি লিখিত হয়, তাহলে হয় তার লিখিত জবাবু নয় কবল-জবাবু দেওয়া যায়। কিন্তু বক্তৃতা হল ধম জ্যোতি সলিল ও মরতের সন্নিপাত। উড়ো-কথার সঙ্গে কোন্দল করতে হলে হাওয়ায় ফাঁদ পাতা আবশ্যক; সে বিদ্যে আমার নেই। তবে পালমহাশয় যখন এদেশের এ যুগের একজন অগ্রগণ্য গুণী, তখন তিনি আমাদের ন্যায় নগণ্য লেখকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উপস্থিত করলে আমরা তার কৈফিয়ত দিতে বাধ্য।