একথা আমি অস্বীকার করি নে যে, সাহিত্যে চাবুকের সার্থকতা আছে। হাসিতে রস এবং কষ দুইই আছে। এবং ঠিক মাত্রা-অনুসারে কষের খাদ দিতে পারলে হাস্যরসে জমাট বাঁধে। কিন্তু তাই বলে ‘কষে’র মাত্রা অধিক বাড়ানো উচিত নয় যে, তাতে হাসি জিনিসটা ক্রমে অন্তর্হিত হয়ে, যা খাঁটি মাল বাকি থাকে, তাতে শুধু ‘কশাঘাত’ করা চলে। সাহিত্যেও অপরের গায়ে নাইট্রিক অ্যাসিড ঢেলে দেওয়াটা বীরত্বের পরিচয় নয়। দ্বিজেন্দ্রবাবু ‘কষাঘাত’কে ‘কশাঘাত’ বলে ভুল করে ষত্ব-ণত্ব জ্ঞানের পরিচয় দেন নি। সাহিত্যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের উপর চাবুক প্রয়োগ করাটা অনাচার। সমগ্র সমাজের পণ্ঠেই ওর প্রয়োগটা সনাতন প্রথা। মিথ্যা যখন সমাজে আশকারা পেয়ে সত্যের সিংহাসন অধিকার করে বসে, এবং রীতি যখন নীতি বলে সম্মান লাভ করে ও সমগ্র সমাজের উপর নিজের শাসন বিস্তার করে, তখনই বিদ্রূপের দিন আসে। পৃথিবীতে সব চাপা যায়, কিন্তু হাসি চাপা যায় না। ব্যক্তিবিশেষের প্রতি চাবুকের প্রয়োগ চলে না। কোনো লেখক যদি নিতান্ত অপদার্থ হয়, তাহলে তার উপর কশাঘাত করাটা কেবল নিষ্ঠুরতা; কেননা, গাধা পিটে ঘোড়া হয় না। অপরপক্ষে যদি কোনো লেখক সত্যসত্যই সরস্বতীর বরপুত্র হন, তাহলে তাঁর লেখার কোনো বিশেষ অংশ কিংবা ধরন মনোমত না হলেও, সেই বিশেষ ধরনের প্রতি যেরূপ বিদ্রূপ সংগত, সেরূপ বিদ্রূপকে আর যে নামেই অভিহিত কর, ‘চাবুক’ বলা চলে না। কারণ, ওরূপ ক্ষেত্রে কবির মর্যাদা রক্ষা না করে বিদ্রূপ করলে সমালোচকেরও আত্মমর্যাদা রক্ষিত হয় না। কোনো ফাঁক পেলেই কলি যেভাবে নলের দেহে প্রবেশ করেছিলেন, সমালোচকের পক্ষে সেইভাবে কবির দেহে প্রবেশ করা শোভনও নয়, সংগতও নয়।
৫.
চাবুক ব্যবহার করবার আর-একটি বিশেষ দোষ আছে। ও কাজ করতে করতে মানুষের খন চড়ে যায়। দ্বিজেন্দ্রবাবরও তাই হয়েছে। তিনি একমাত্র ‘চাবুকে’ সন্তুষ্ট না থেকে, ক্রমে ‘ঝাঁটিকা’ ‘চাঁটিকা’ প্রভৃতি পদার্থেরও প্রয়োগ করবার চেষ্টা করেছেন। আমি বাংলায় অনাবশ্যক ‘ইকা’প্রত্যয়ের বিরোধী। সুতরাং আমি নির্ভয়ে দ্বিজেন্দ্রবাবকে এই প্রশ্ন করতে পারি যে, ‘চাঁটিকা’র ‘ইকা’ বাদ দিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে, সে-জিনিসটে মারাতে কি কোনো লেখকের পদমর্যাদা বৃদ্ধি পায়? ‘ঝাঁটা’ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, সম্মার্জনীর উদ্দেশ্য ধুলোঝাড়া, গায়ের ঝালঝাড়া নয়। বিলেতিসরস্বতী মাঝেমাঝে রণচণ্ডী মতি ধারণ করলেও বঙ্গসরস্বতীর পক্ষে ঝাঁটা উঁচিয়ে রঙ্গভূমিতে অবতীর্ণ হওয়াটা যে নিতান্ত অবাঞ্ছনীয়, একথা বোধ হয় কেউ অস্বীকার করবেন না।
৬.
শ্ৰীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নিজে মার-মতি ধারণ করবার যে কারণ দেখিয়েছেন, আমার কাছে সেটি সবচেয়ে অদ্ভুত লাগল। দ্বিজেন্দ্রবাবর মতে, যদি কোনো কবি কোনো কাব্যকে সাহিত্যের পক্ষে অমঙ্গলকর বিবেচনা করেন, তাহা হইলে সেরূপ কাব্যকে সাহিত্যক্ষেত্র হইতে চাবকাইয়া দেওয়া তাঁহার কর্তব্য।
এককথায়, সাহিত্যের মঙ্গলের জন্য নৈতিক চাবুক মারাই দ্বিজেন্দ্রবাবুর অভিপ্রায়। পৃথিবীতে অনেক লোকের ধারণা যে কাউকে ধর্মাচরণ শেখাতে হলে মৃত্যুর মত তার চুল চেপে ধরাটাই তার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়, এবং সেইজন্য কর্তব্য। স্কুলে জেলখানায় ঐ সমাজের মঙ্গলের জন্যই বেত মারবার নিয়ম প্রচলিত ছিল। কিন্তু আজকাল অনেকেরই এ জ্ঞান জন্মেছে যে, ও পদ্ধতিতে সমাজের কোনো মঙ্গলই সাধিত হয় না; লাভের মধ্যে শুধু যে বেত মারে এবং যাকে মারা হয়, উভয়েই তার ফলে মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুত্ব লাভ করে। অপরের উপর অত্যাচার করবার জন্য শারীরিক বলের প্রয়োগটা যে বর্বরতা, একথা সকলেই মানেন; কিন্তু একই উদ্দেশ্যে নৈতিক বলের প্রয়োগটাও যে বর্বরতামাত্র, এ সত্য আজও সকলের মনে বসে যায় নি। কঠিন শাস্তি দেবার প্রবৃত্তিটি আসলে রূপান্তরে প্রতিহিংসাপ্রবত্তি। ও জিনিসটিকে সমাজের মঙ্গলজনক মনে করা শুধু নিজের মনভোলানো মাত্র। নীতিরও একটা বোকামি গোঁড়ামি এবং গণ্ডামি আছে। নিত্যই দেখতে পাওয়া যায়, একরকম প্রকৃতির লোকের হাতে নীতি-পদার্থটা পরের উপর অত্যাচার করবার একটা অমাত্র। ধর্ম এবং নীতির নামে মানুষকে মানুষে যত কষ্ট দিয়েছে, যত গহিত কার্য করেছে, এমন বোধ হয় আর কিছুরই সাহায্যে করে নি। আশা করি দ্বিজেন্দ্রবাবু সে শ্রেণীর লোক নন, যাঁদের মতে সুনীতির নামে সাত খুন মাপ হয়। ইতিহাসে এর ধারাবাহিক প্রমাণ আছে যে, নীতির বোকামি গোঁড়ামি এবং গুণ্ডামির অত্যাচার সাহিত্যকে পুরোমাত্রায় সহ্য করতে হয়েছে। কারণ, সাহিত্য সকল দেশে সকল যুগেই বোকামি গোঁড়ামি এবং গুণ্ডামির বিপক্ষ এবং প্রবল শত্র।
নীতির, অর্থাৎ যুগবিশেষে প্রচলিত রীতির, ধর্মই হচ্ছে মানুষকে বাঁধা; কিন্তু সাহিত্যের ধর্ম হচ্ছে মানুষকে মুক্তি দেওয়া। কাজেই পরস্পরের সঙ্গে দা-কুমড়োর সম্পর্ক। ধর্ম এবং নীতির দোহাই দিয়েই মুসলমানেরা আলেকজান্ড্রিয়ার লাইব্রেরি ভস্মসাৎ করেছিল।
এ যুগে অবশ্য নীতিবীরদের বাহুবলের এক্তিয়ার হতে আমরা বেরিয়ে গেছি, কিন্তু সুনীতির গোয়েন্দারা আজও সাহিত্যকে চোখে-চোখে রাখেন, এবং কারও লেখায় কোনো ছিদ্র পেলেই সমাজের কাছে লেখককে ধরিয়ে দিতে উৎসুক হন। কাব্যামৃতরসাস্বাদ করা এক, কাব্যের ছিদ্রান্বেষণ করা আর। শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি কবিতার রূপকমাত্র। কারণ, সে বাঁশির ধর্মই এই যে, তা ‘মনের আকুতি বেকত করিতে কত না সন্ধান জানে’। ছিদ্রান্বেষী নীতি ধর্মীদের হাত পড়লে সে বাঁশির ফটোগুলো যে তাঁরা বাজিয়ে দিতে চেষ্টা করবেন, তাতে আর সন্দেহ কি। একশ্রেণীর লোক চিরকালই এই চেষ্টা করে অকৃতকার্য হয়েছেন; কারণ, সে ছিদ্র স্বয়ং ভগবানের হাতে-করা বিঁধ, তাকে নিরেট করে দেবার ক্ষমতা মানুষের হাতে নেই। ‘মি’-জিনিসটিই খারাপ, কিন্তু আমাদের শাস্ত্রমতে, মানুষের পক্ষে সবচাইতে সর্বনেশে ‘মি’ হচ্ছে ‘আমি’। কারণ, ও পদার্থটির আধিক্য থাকলে আমাদের বিদ্যাবৃদ্ধি কাণ্ডজ্ঞান সবই লুপ্ত হয়ে আসে। অন্যান্য সকল ‘মি’ ঐ ‘আমি’কে আশ্রয় করেই থাকে। কিন্তু ‘আমি’ এত অব্যক্তভাবে আমাদের সমস্ত মনটায় ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে যে, আমরা নিজেও বুঝতে পারি নে যে, তারই তাড়নায় আমরা পরের উপর কুব্যবহার করতে উদ্যত হই, সমাজ কিংবা সাহিত্য কারও মঙ্গলের জন্য নয়। এইকথাটা স্পষ্ট বুঝতে পারলে আমরা পরের উপর নৈতিক চাবুক প্রয়োগ করতে কুণ্ঠিত হই। এই কারণেই, যদি একজন কবি অপর-একজন সমসাময়িক কবির সমালোচক হয়ে দাঁড়ান, তাহলে তাঁর নিকট কবি এবং কাব্যের ভেদবুদ্ধিটি নষ্ট হওয়া অতি সহজ।