এ পৃথিবীতে মানুষে আসলে খালি দুটি কার্যই করতে জানে; সে হচ্ছে হাসতে এবং কাঁদতে। আমরা সকলেই নিজে হাসতেও জানি, কাঁদতেও জানি; কিন্তু সকলেরই কিছু,আর অপরকে হাসাবার কিংবা কাঁদাবার শক্তি নেই। অবশ্য অপরকে চপেটাঘাত করে কাঁদানো কিংবা কাতুকুতু দিয়ে হাসানো আমাদের সবারই আয়ত্ত, কিন্তু সরস্বতীর বীণার সাহায্যে কেবল দুটিচারটি লোকই ঐ কার্য করতে পারেন। যাঁদের সে ভগবৎদত্ত ক্ষমতা আছে, তাঁদেরই আমরা কবি বলে মেনে নিই। বাদবাকি সব বাজে লেখক। কাব্যে, আমার মতে, শুধু তিনটিমাত্র রস আছে : করণ রস, হাস্যরস, আর হাসিকান্নামিশ্রিত মধুর রস। যে লেখায় এর একটি-না-একটি রস আছে, তাই কাব্য; বাদবাকি সব নীরস লেখা। দর্শন বিজ্ঞান ইত্যাদি যা খুশি তা হতে পারে, কিন্তু কাব্য নয়। বাংলাসাহিত্যে হাস্যরসে শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় অদ্বিতীয়। তাঁর গানে হাস্যরস ভাবে কথায় সরে তালে লয়ে পঞ্চীকৃত হয়ে মতিমান হয়ে উঠেছে। হাসির গান তাঁর সঙ্গে জড়িতে গাইতে পারে, বঙ্গসাহিত্যের আসরে এমন গুণী আর-একটিও নেই। কান্নার মত হাসিরও নানাপ্রকার বিভিন্ন রূপে আছে, এবং দ্বিজেন্দ্রবাবুর মুখে হাসি নানা আকারেই প্রকাশ পেয়েছে। সাহিত্যে যে কেবল আমাদের মিষ্টি হাসিই হাসতে হবে, একথা আমি মানি নে। সুতরাং দ্বিজেন্দ্রবাবু যে বলেছেন যে, কাব্যে বিদ্রুপের হাসিরও ন্যায্য স্থান আছে, সেকথা সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু উপহাস জিনিসটের প্রাণই হচ্ছে হাসি। হাসি বাদ দিলে শুধু তার উপটুকু থাকে, কিন্তু তার রূপটকু থাকে না। হাসতে হলেই আমরা অল্পবিস্তর দন্তবিকাশ করতে বাধ্য হই। কিন্তু দন্তবিকাশ করলেই যে সে ব্যাপারটা হাসি হয়ে ওঠে তা নয়; দাঁতখিচুনি বলেও পৃথিবীতে একটা জিনিস আছে সে ক্রিয়াটি যে ঠিক হাসি নয়, বরং তার উলটো, জীবজগতে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ আছে। সুতরাং উপহাস-জিনিসটে সাহিত্যে চললেও, কেবলমাত্র তার মুখভঙ্গিটি সাহিত্যে চলে না। কোনো জিনিস দেখে যদি আমাদের হাসি পায়, তাহলেই আমরা অপরকে হাসাতে পারি। কিন্তু কেবলমাত্র যদি রাগই হয়, তাহলে সে মনোভাবকে হাসির ছদ্মবেশ পরিয়ে প্রকাশ করলে দর্শকমণ্ডলীকে শুধু রাগাতেই পারি। দ্বিজেন্দ্রবাবু এইকথাটি মনে রাখলে লোককে হাসাতে গিয়ে রাগাতেন না।
৩.
দ্বিজেন্দ্রবাবু বলেছেন যে, নাটকাকারে প্যারডি কোনো ভাষাতেই নেই। যা কোনো দেশে কোনো ভাষাতেই ইতিপূর্বে রচিত হয় নি, তাই সৃষ্টি করতে গিয়ে তিনি একটি অদ্ভুত পদার্থের সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বামিত্রের তপোবল আমাদের কারও নেই; সুতরাং বিশ্বামিত্রও যখন নূতন সৃষ্টি করতে গিয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন, তখন আমরা যে হব, এ তো নিশ্চিত।
মানুষে মুখ ভ্যাংচালে দর্শকমাত্রই হেসে থাকে। কেন যে সে কাজ করে, তার বিচার অনাবশ্যক; কিন্তু ঘটনা হচ্ছে এই যে, ওরূপ মুখভঙ্গি দেখলে মানুষের হাসি পায়। প্যারডি হচ্ছে সাহিত্যে মুখ-ভ্যাংচানো। প্যারডি নিয়ে যে নাটক হয় না, তার কারণ দু ঘণ্টা ধরে লোকে একটানা মুখে ভেংচে যেতে পারে না; আর যদিও কেউ পারে তো, দর্শকের পক্ষে তা অসহ্য হয়ে ওঠে। হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য দেখা দেয় বলেই, এবং তার কোনো মানেমোন্দা নেই বলেই, মানুষের মুখ-ভ্যাংচানি দেখে হাসি পায়। সতরাং ভ্যাংচানির মধ্যে দর্শন বিজ্ঞান সনীতি সুরুচি প্রভৃতি ভীষণ জিনিস সব পুরে দিতে গেলে ব্যাপারটা মানুষের পক্ষে রুচিকর হয় না। ঐরূপ করাতে ভ্যাংচানির শুধু ধর্ম নষ্টই হয়। শিক্ষাপ্রদ ভ্যাংচানির সৃষ্টি করতে গিয়ে দ্বিজেন্দ্রবাবু রসজ্ঞানের পরিচয় দেন নি। যদি প্যারডির মধ্যে কোনোরূপ দর্শন থাকে তো সে দন্তের দর্শন।
৪.
দ্বিজেন্দ্রবাবু তাঁর ‘আনন্দ-বিদায়ে’র ভূমিকায় প্রকারান্তরে স্বীকারই করেছেন যে, লোকহাসানো নয়, লোকশিক্ষা দেওয়াই তাঁর মনোগত অভিপ্রায়; প্রহসন শুধু অছিলামাত্র। বেত হাতে গুরুমশাইগিরি করা, এ যুগের সাহিত্যে কোনো লোকের পক্ষেই শোভা পায় না। পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে।।—একথা শুধু অবতীর্ণ ভগবানের মুখেই সাজে, সামান্য মানবের মুখে সাজে না। লেখকেরা যদি নিজেদের এক-একটি ক্ষুদ্র অবতারস্বরূপ মনে করেন, কিংবা যদি তাঁরা সকলে কেষ্টবিষ্ট হয়ে ওঠেন, তাহলে পৃথিবীর সাধুদেরও পরিত্রাণ হবে না, এবং দুষ্টদেরও শাসন হবে না; লাভের মধ্যে লেখকেরা পরস্পর শুধু কলমের খোঁচাখুচি করবেন। দ্বিজেন্দ্রবাবুর ইচ্ছাও যে তাই হয়। এবং তিনি ঐরূপ খোঁচাখুঁচি হওয়াটা যে উচিত, তাই প্রমাণ করবার জন্যে বিলেতি নজির দেখিয়েছেন। তিনি বলেন যে, ওআর্ডসওআর্থকে ব্রাউনিং চাব্কেছিলেন, এবং ওআর্ডসওআর্থ বায়ুরন এবং শেলিকে চাব্কেছিলেন। বিলেতের কবিরা যে অহরহ পরস্পরকে চাবকা-চাবকি করে থাকেন, এ জ্ঞান আমার ছিল না।
ওআর্ডসওআর্থ সম্বন্ধে ব্রাউনিং Lost Leader নামে যে একটি ক্ষুদ্র কবিতা রচনা করেন, সেটিকে কোনো হিসাবেই চাবুক বলা যায় না। কবিসমাজের সর্বমান্য এবং পূজ্য দলপতি দলত্যাগ করে অপর-দলভুক্ত হওয়াতে কবিসমাজ যে গভীর বেদনা অনুভব করেছিলেন, ঐ কবিতাতে ব্রাউনিং সেই দুঃখই প্রকাশ করেছেন। ওআর্ডসওআর্থ যে বায়ুরন এবং শেলিকে চাবকেছিলেন, একথা আমি জানতুম না। বায়ুরন অবশ্য তাঁর সমসাময়িক কবি এবং সমালোচকদের প্রতি দু হাতে ঘুঁষো চালিয়েছিলেন, কিন্তু সে আত্মরক্ষার্থ। অহিংসা পরমধর্ম হলেও আততায়ী-বধে পাপ নেই। দ্বিজেন্দ্রবাবু যে নজির দেখিয়েছেন, সেই নজিরের বলেই প্রমাণ করা যায় যে, চাবুক পদার্থটার বিলেতি কবিসমাজে চলন থাকলেও তার ব্যবহারে যে সাহিত্যের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে, তা নয়। ওআর্ডসওআর্থ শেলি বায়ুরন প্রভৃতি কোনো কবিই কোনো প্রতিদ্বন্দীর তাড়নার ভয়ে নিজের পথ ছাড়েন নি, কিংবা সাহিত্যরাজ্যে পাশ কাটিয়ে যাবারও চেষ্টা করেন নি। কবিমাত্রেরই মত যে ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরঃধর্মে ভয়াবহ’। চাবুকের ভয় কেবলমাত্র তারাই করে, যাদের ‘স্বধর্ম বলে জিনিসটা আদপেই নেই এবং সাহিত্যে পরমুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ শ্রেণীর লেখকেরা কি লেখেন আর না-লেখেন, তাতে সমাজের কিংবা সাহিত্যের বড়-কিছু আসে যায় না।