আসলে, ছেলেরা ভালোবাসে শুধু রূপকথা–স্বরূপ কথাও নয়, অরূপ কথাও নয়; অর্থাৎ জ্ঞানের কথাও নয়, নীতির কথাও নয়। উপরে যেসব বইয়ের নাম করা গেল, তার প্রতিটিতেই রূপকথার রূপ আছে। আমরা যে শিশসাহিত্য রচনা করতে পারি নে, তার কারণ আমরা চেষ্টা করলেও রূপকথা তৈরি করতে পারি নে। যে যুগে রূপেকথার সৃষ্টি হয়, সে যুগ হচ্ছে মানবসভ্যতার শৈশব। সেকালে লোক মনে শিশ ছিল, সে যুগে সম্ভব-অসম্ভবের ভেদজ্ঞান মানুষের মনে তেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। একালের আমরা মনে জানি সবই অসম্ভব, আর ছেলেরা মনে করে সবই সম্ভব। তাছাড়া, আমাদের কাছে পৃথিবীর সব জিনিসই আবশ্যক, কোনো জিনিসই চমৎকার নয়; আর ছেলেদের কাছে সব জিনিসই চমৎকার, কোনো জিনিসই আবশ্যক নয়। সুতরাং আমাদের পক্ষে তাদের মনোমত সাহিত্য রচনা করা অসম্ভব। আমরা রূপকথা লিখতে বসলে, হয় তা কিছুই হবে না, নয় রূপক হবে; কেননা, রূপকথার জন্ম সত্যযুগে, আর রূপকের জন্ম সভ্যযুগে।
এই রূপকের মধ্যেই হাজারে একখানা ছেলেদের কাছে নবরুপকথা হয়ে দাঁড়ায়, যথা ডন-কুইকসোট গালিভার’স-ট্রাভেলস ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এ জাতের রূপকথা রচনা করবার জন্য অসামান্য প্রতিভার আবশ্যক। অসম্ভবকে সম্ভব, কল্পনাকে বাস্তব করে তোলা এককথায়, বস্তুজগতের নিয়ম অতিক্রম করে একটি নববস্তুজগৎ গড়ে তোলা তোমার-আমার কর্ম নয়। আর যাঁর অসামান্য প্রতিভা আছে, তাঁর বই-লেখার উদ্দেশ্য ছেলেদের এ বোঝানো নয় যে, তারা মনে পাকা; কিন্তু বুড়োদের এই বোঝানো যে, তারা মনে কাঁচা। বয়েসে বদ্ধ কিন্তু মনে বালক–এমন সাহিত্যিক যে নেই, একথা আমি বলতে চাই নে। কিন্তু সে সাহিত্যিকের দ্বারাও শিশু-সাহিত্য রচিত হতে পারে না, তার কারণ ছোটছেলে ও বড়োখোকা— এ দুই একজাতীয় জীব নয়। বয়স্কলোকের বালিশতার মূল হচ্ছে সত্য ধরবার অক্ষমতা, আর বালকের বালকত্বের মূল হচ্ছে কল্পনা করবার সক্ষমতা। সুতরাং আমার মতে, বিশেষ করে শিশু-সাহিত্য রচনা হতে আমাদের নিরস্ত থাকাই শ্রেয়। আমরা যদি ঠিক আমাদের-উপযোগী বই লিখি, খুব সম্ভবত তা শিশু-সাহিত্যই হবে।
অগ্রহায়ণ ১৩২৩
সবুজপত্র
বাংলাদেশ যে সবুজ, একথা বোধ হয় বাহ্যজ্ঞানশূন্য লোকেও অস্বীকার করবেন না। মা’র শস্যশ্যামলরপ বাংলার এত গদ্যেপদ্যে এতটা পল্লবিত হয়ে উঠেছে যে, সে বর্ণনার যাথার্থ বিবাস করবার জন্য চোখে দেখবারও আবশ্যক। নেই। পনেরক্তির গুণে এটি সেই শ্রেণীর সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার সম্বন্ধে চক্ষুকণের যে বিবাদ হতে পারে, এরূপ সন্দেহ আমাদের মনে মহতের জন্যও স্থান পায় না। এক্ষেত্রে সৌভাগ্যবশত নাম ও রূপের বাস্তবিকই কোনো বিরোধ নেই। একবার চোখ তাকিয়ে দেখলেই দেখা যায় যে, তরাই হতে সুন্দরবন পর্যন্ত এক ঢালা সবুজবৰ্ণ দেশটিকে আদ্যোপান্ত ছেয়ে রেখেছে। কোথাও তার বিচ্ছেদ নেই, কোথাও তার বিরাম নেই। শুধু তাই নয়, সেই রং বাংলার সীমানা অতিক্রম করে উত্তরে হিমালয়ের উপরে ছাপিয়ে উঠেছে ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের ভিতর চারিয়ে গেছে।
সবুজ, বাংলার শুধু, দেশজোড়া রং নয়–বারোমেসে রং। আমাদের দেশে প্রকৃতি বহুরূপী নয়, এবং ঋতুর সঙ্গেসঙ্গে বেশ পরিবর্তন করে না। বসন্তে বিয়ের কনের মত ফলের জহরতে আপাদমস্তক সালংকারা হয়ে দেখা দেয় না, বর্ষার জলে শুচিস্নাতা হয়ে শরতের পূজার তসর ধারণ করে আসে না, শীতে বিধবার মত শাদা শাড়িও পরে না। মাধব হতে মধ পর্যন্ত ঐ সবুজের টানা সুর চলে; ঋতুর প্রভাবে সে সুরের যে রূপান্তর হয়, সে শুধু কড়িকোমলে। আমাদের দেশে অবশ্য বর্ণের বৈচিত্র্যের অভাব নেই। আকাশে ও জলে, ফলে ও ফলে আমরা বর্ণগ্রামের সকল সুরেরই খেলা দেখতে পাই। কিন্তু মেঘের রং ও ফলের রং ক্ষণস্থায়ী; প্রকৃতির ওসকল রাগরঙ্গ তার বিভাব ও অভাব মাত্র। তার স্থায়ী ভাবের, তার মূল রসের পরিচয় শুধু সবজে। পাঁচরঙা ব্যাভিচারীভাবসকলের সার্থকতা হচ্ছে বঙ্গদেশের এই অখণ্ডহরিৎ স্থায়ী ভাবটিকে ফুটিয়ে তোলা।
এরূপ হবার অবশ্য একটা অর্থ আছে। বর্ণমাত্রেই ব্যঞ্জন বর্ণ; অর্থাৎ বর্ণের উদ্দেশ্য শুধু বাহ্যবস্তুকে লক্ষণান্বিত করা নয়, কিন্তু সেই সুযোগে নিজেকেও ব্যক্ত করা। যা প্রকাশ নয়, তা অপর কিছুই প্রকাশ করতে পারে না। তাই রং রূপও বটে, রূপকও বটে। যতক্ষণ আমাদের বিভিন্ন বর্ণের বিশেষ ব্যক্তিত্বের জ্ঞান না জন্মায়, ততক্ষণ আমাদের প্রকৃতির বর্ণপরিচয় হয় না এবং আমরা তার বক্তব্য কথা বুঝতে পারি নে। বাংলার সবুজপত্রে যে সুসমাচার লেখা আছে, তা পড়বার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক হবার আবশ্যক নেই। কারণ সে লেখার ভাষা বাংলার প্রাকৃত। তবে আমরা সকলে যে তার অর্থ বুঝতে পারি নে, তার কারণ হচ্ছে যিনি গুপ্ত জিনিস আবিষ্কার করতে ব্যস্ত, ব্যক্ত জিনিস তাঁর চোখে পড়ে না।
যাঁর ইন্দ্রধনুর সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় আছে আর তার জন্মকথা জানা আছে, তিনিই জানেন যে, সূর্যকিরণ নানা বর্ণের একটি সমন্টিমাত্র এবং শুধু সিধে পথেই সে শাদা ভাবে চলতে পারে। কিন্তু তার সরল গতিতে বাধা পড়লেই সে সমষ্টি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বক্র হয়ে বিচিত্র ভঙ্গি ধারণ করে, এবং তার বর্ণসকল পাঁচ বর্গে বিভক্ত হয়ে যায়। সবুজ হচ্ছে এই বর্ণমালার মধ্যমণি, এবং নিজগুণেই সে বর্ণরাজ্যের কেন্দ্রস্থল অধিকার করে থাকে; বেগুনি কিশলয়ের রং, জীবনের পরাগের রং; লাল রক্তের রং, জীবনের পর্ণেরাগের রং; নীল আকাশের রং, অনন্তের রং; পীত শপত্রের রং, মৃত্যুর রং। কিন্তু সবুজ হচ্ছে নবীন পত্রের রং, রসের ও প্রাণের যুগপৎ লক্ষণ ও ব্যক্তি; তার দক্ষিণে নীল আর বামে পীত, তার পবসীমায় বেগুনি আর পশ্চিমসীমায় লাল। অত ও অনন্তের মধ্যে, পূর্বে ও পশ্চিমের মধ্যে, স্মৃতি ও আশার মধ্যে মধ্যস্থতা করাই হচ্ছে সবরে, অর্থাৎ সরস প্রাণের, স্বধর্ম।