আমাদের পক্ষে কি শিক্ষা ভালো, তা নির্ণয় করবার পূর্বে–আমরা কি হতে চাই, সেবিষয়ে মনঃস্থির করা আবশ্যক। কেননা, একটা স্পষ্ট জাতীয় আদশ না থাকলে, জাতীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে না। ধরন, যদি অশ্বত্ব-লাভ-করা গর্দভদের জাতীয় আদর্শ করে তোলা যায়, তাহলে অবশ্য সে জাতির শিক্ষকেরাও তাদের জন্য পেটনের ব্যবস্থা করবেন; অপরপক্ষে গভত্ব লাভ করা যদি অন্যদের জাতীয় আদর্শ করে তোলা যায়, তাহলে সে জাতির শিক্ষকেরাও তাদের জন্য ঐ পেটনেরই ব্যবস্থা করবেন। হয় গাধা-পিটে-ঘোড়া, নয় ঘোড়া-পিটে-গাধা করাই যে শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য–সাধারণত এইটেই হচ্ছে লোকের ধারণা। এবং আমরা এই উভয়ের মধ্যে যে কোন, জাতীয়, সেবিষয়ে দেশে-বিদেশে বিষম মতভেদ থাকলেও পেটন দেওয়াটাই যে শিক্ষা দেবার একমাত্র পদ্ধতি, সেবিষয়ে বিশেষ কোনো মতভেদ নেই। কাজেই আমাদের শিক্ষকেরা এক হাতে সংস্কৃত, আর-এক হাতে ইংরেজি ধরে আমাদের উপর দ হাতে চাবুক চালাচ্ছেন। এর ফলে কত গাধা ঘোড়া এবং কত ঘোড়া গাধা হচ্ছে–তা বলা কঠিন; কেননা, এবিষয়ের কোনো স্ট্যাটিস্টিকস অদ্যাবধি সংগ্রহ করা হয় নি।
সে যাই হোক, যে জাতীয় আদর্শের উপর জাতীয় শিক্ষা নির্ভর করে, তা যুগপৎ মনের এবং জীবনের আদর্শ হওয়া দরকার। যেদেশে জাতীয় শিক্ষা আছে, সেদেশের প্রতি ঈষৎ দৃষ্টিপাত করলেই এ সত্য সকলের কাছেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে। ইউরোপে আমরা দেখতে পাই যে, জর্মানি চেয়েছিল যা নই তাই হব’, ইংলণ্ড যা আছি তাই থাকব, আর ফ্রান্স যা আছি তাও থাকব না, যা নই তাও হব না; এবং এই তিন দেশের গত পঞ্চাশ বৎসরের কাজ ও কথার ভিতর নিজ-নিজ জাতীয় আদর্শের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যাবে।
কিন্তু আমাদের বিশেষত্ব এই যে, আমরা জীবনে এক পথে চলতে চাই–মনে আর-এক পথে।
আমাদের ব্যক্তিগত মনের আদর্শ হচ্ছে ‘যা ছিলুম তাই হওয়া’, আর আমাদের জাতিগত জীবনের আদর্শ হচ্ছে ‘যা ছিলুম না তাই হওয়া’। ফলে আমাদের সামাজিক বুদ্ধির মুখে প্রাচীন ভারতবর্ষের দিকে আর আমাদের রাষ্ট্রীয় বুদ্ধির মুখ নবীন ইউরোপের দিকে। এই আদর্শের উভয়সংকটে পড়ে আমরা শিক্ষার একটা সপথ ধরতে পারছি নে— স্কুলেও নয়, সাহিত্যেও নয়।
একজন ইংরেজ দার্শনিক বলেছেন যে, সমস্যাটা যে কি এবং কোথায়, সেইটে ধরাই কঠিন; তার মীমাংসা করা সহজ। একথা সত্য। শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ তাই ‘ঘরেবাইরে’য় আমাদের জাতীয় সমস্যার ছবি এঁকেছেন; কেননা, ও-উপন্যাসখানি একটি রূপক-কাব্য ছাড়া আর-কিছুই নয়। নিখিলেশ হচ্ছেন প্রাচীন ভারতবর্ষ, সন্দীপ নবীন ইউরোপ, আর বিমলা বর্তমান ভারত। এই দোটানার ভিতর পড়েই বিমলা বেচারা নাস্তানাবুদ হচ্ছে, মুক্তির পথ যে কোন দিকে, তা সে খুঁজে পাচ্ছে না। এরূপ অবস্থায় এক সৎশিক্ষা ব্যতীত তার উদ্ধারের উপায়ান্তর নেই। অতএব এক্ষেত্রে আমাদের পক্ষে শিক্ষার একটি আদর্শ খুঁজে-পেতে বার করা দরকার।
আমি বহু গবেষণার ফলেও সে আদর্শ আজও আবিষ্কার করতে পারি নি, সুতরাং সে আদর্শ নিজেই গড়তে বাধ্য হয়েছি। আমি স্বজাতিকে অনুরোধ করি যে, আমার এই গড়া আদর্শ যেন বিনা পরীক্ষায় পরিহার না করেন।
শ্ৰীমতী লীলা মিত্র নামক জনৈক ভদ্রমহিলা ‘সবুজপত্রে’ এই মত প্রকাশ করেন যে, এদেশে শিক্ষার আদর্শ ভুল, সুতরাং তার পদ্ধতিও নিরর্থক। তাঁর মতে আমরা প্রীজাতিকে সেই শিক্ষা দিতে চাই, যাতে তারা পুরুষজাতির কাজে লাগে, সুতরাং সে শিক্ষা নিল। একথা সম্ভবত সত্য। তিনি চান যে শ্রীজাতি নিজের শিক্ষার ভার নিজ-হস্তে গ্রহণ করেন। এ হলে তো আমরা বাঁচি। আমাদের মেয়েরা যদি নিজের বিবাহের ভার নিজের হাতে নেন, তাহলে দেশসুদ্ধ লোক যেমন কন্যাদায় হতে অমনি নিষ্কৃতি লাভ করে, তেমনি মা-লক্ষীরা যদি নিজ-গুণে মা-সরস্বতী হয়ে ওঠেন, তাহলে স্ত্রীশিক্ষার সমস্যা আমাদের আর মীমাংসা করতে হয় না।
সে যাই হোক, আমি বলি, পুরুষজাতিকে সেই শিক্ষা দেওয়া হোক, যাতে তারা স্ত্রীজাতির কাজে লাগে। শিক্ষার এ আদর্শ কোনো কালে কোনো দেশে ছিল না বলেই আমাদের পক্ষে তা গ্রাহ্য করা উচিত। পুরুষজাতি যদি এই আদর্শে শিক্ষিত হয়, তাহলে আর কিছু না হোক, পৃথিবীর মারামারিকাটাকাটি সব থেমে যাবে। নিখিলেশ ও সন্দীপ যদি বিমলাকে নিজের নিজের কাজে লাগাতে চেষ্টা না করে নিজেদের বিমলার কাজে লাগাতে চেষ্টা করতেন, তাহলে গোল তো সব মিটেই যেত। অতএব আমরা যাতে বিমলার কাজে লাগি, সেইরকম আমাদের শিক্ষা হওয়া কর্তব্য।
মাঘ ১৩২২
শিশু-সাহিত্য
যে-কোনো ভাষাতেই হোক না কেন, সমাস-ব্যবহারের ভিতর যে বিপদ আছে, সেবিষয়ে শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র ঘটক আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। আমরা যদি কথার গায়ে কথা জড়িয়ে লিখি, তাহলে পাঠকদের পক্ষে তা ছাড়িয়ে নিয়ে পড়া কঠিন। ত্বষ্টা পত্ৰ বত্রকে আশীর্বাদ করেছিলেন ইন্দ্রশ হও’। কিন্তু সমাসের কৃপায় সে বর যে কি মারাত্মক শাপে পরিণত হয়েছিল, তার আমল বিবরণ শতপথ ব্রহণে’ দেখতে পাবেন। সুতরাং পাঠক যাতে উলটো না বোঝেন, সে কারণ এ প্রবন্ধের সমস্ত-নামটির অর্থ প্রথমেই বলে রাখা আবশ্যক। এ প্রবন্ধে ব্যবহৃত শিশু-সাহিত্যের অর্থ বঙ্গসাহিত্য নয়। শিশুদের জন্য বাংলাভাষায় যে সাহিত্যের আজকাল নিত্যনব সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেই সাহিত্যই আমার বিচার্য।