শিবজ্ঞান আসে সবচাইতে আগে। কেননা, মোটামুটি ও-জ্ঞান না থাকলে সমাজের সৃষ্টিই হয় না, রক্ষা হওয়া তো দুরের কথা। ও জ্ঞান বিষয়বৃদ্ধির উত্তমাঙ্গ হলেও একটা অঙ্গমাত্র।
তার পর আসে সত্যের জ্ঞান। এ জ্ঞান শিবজ্ঞানের চাইতে ঢের সক্ষমজ্ঞান এবং এ জ্ঞান আংশিকভাবে বৈষয়িক, অতএব জীবনের সহায়; এবং আংশিকভাবে তার বহির্ভূত, অতএব মনের সম্পদ।
সবশেষে আসে রূপজ্ঞান। কেননা, এ জ্ঞান অতিসক্ষম এবং সাংসারিক হিসেবে অকেজো। রূপজ্ঞানের প্রসাদে মানুষের মনের পরমায়ু বেড়ে যায়, দেহের নয়। সুনীতি সভ্যসমাজের গোড়ার কথা হলেও সুরুচি তার শেষকথা। শিব সমাজের ভিত্তি, আর সুন্দর তার অভ্রভেদী চড়া।
অবশ্য হার্বার্ট স্পেনসার বলেছেন যে, মানুষের রূপজ্ঞান আসে আগে এবং সত্যজ্ঞান তার পরে। তার কারণ, যে জ্ঞান তাঁর জন্মায় নি, তিনি মনে করতেন সে জ্ঞান বাতিল হয়ে গিয়েছে। সত্যকথা এই যে, মানবসমাজের পক্ষে রূপজ্ঞান লাভ করাই সাধনাসাপেক্ষ খোয়ানো সহজ। আমাদের পর্বপুরুষদের সাধনার সেই বঞ্চিত ধন আমরা অবহেলাক্রমে হারিয়ে বসেছি। বিলেতি সভ্যতার কেজো অংশের সংস্পর্শে আমাদের মনের ভিত টলকে আর না-টলুক, তার চড়া ভেঙে পড়েছে।
এবিষয়ে বৌদ্ধদর্শনের মত প্রণিধানযোগ্য। বৌদ্ধদার্শনিকেরা কল্পনা করেন যে, এ জগতে নানা লোক আছে। সবনীচে কামলোক, তার উপরে রূপলোক, তার উপরে ধ্যানলোক ইত্যাদি।
আমার ধারণা, আমরা-সব জন্মত কামলোকের অধিবাসী; সুতরাং রূপলোকে যাওয়ার অর্থ আত্মার পক্ষে ওঠা, নামা নয়।
আর-এক কথা, রূপের চর্চার বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি এই যে, আমরা দরিদ্র জাতি–অতএব ও আমাদের সাধনার ধন নয়। এ ধারণার কারণ, ইউরোপের কমার্শিয়ালিজম, আমাদের মনের উপর এ যুগে রাজার মত প্রভুত্ব করছে। সত্যকথা এই যে, জাতীয়-শ্রীহীনতার কারণ অর্থের অভাব নয়, মনের দারিদ্র। তার প্রমাণ, আমাদের হালফ্যাশানের বেশভূষা সাজসজ্জা আচারঅনুষ্ঠানের শ্রীহীনতা সোনার-জলে ছাপানো বিয়ের কবিতার মত আমাদের ধনীসমাজেই বিশেষ করে ফুটে উঠেছে। আসল কথা, আমাদের নবশিক্ষার বৈজ্ঞানিক আলোক আমাদের জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত করুক আর নাই করুক, আমাদের রূপেকানা করেছে। গুণ হয়ে দোষ হল বিদ্যার বিদ্যায়’–ভারতচন্দ্রের একথা সুন্দরের দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে, আমাদের সকলের পক্ষেই সমান খাটে। আর যদি এইকথাই সত্য হয় যে, আমরা সুন্দরভাবে বাঁচতে পারি নে— তাহলে আমাদের সুন্দরভাবে মরাই শ্রেয়। তাতে পৃথিবীর কারও কোনো ক্ষতি হবে না, এমনকি আমাদেরও নয়।
ফাল্গুন ১৩২৩
শিক্ষার নব আদর্শ
শ্ৰীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় যে এদেশের চলতি শিক্ষার দর যাচাই করতে উদ্যত হয়েছেন, এ অতি সুখের কথা। কেননা, বাঙালি যদি কোনো বস্তু লাভ করবার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তো সে হচ্ছে শিক্ষা। সুতরাং আমরা দেশস ভদ্রসন্তান প্রাণপাত করে যা পাই, জহরির কাছে তার মূল্য যে কি, তা জানায় ক্ষতি নেই।
আমরা যে কত শিক্ষালোভী, তার প্রমাণ আমাদের পাঁচ বৎসর বয়েসে হাতে-খড়ি হয়। আর কমসেকম একুশ বৎসর বয়েসে হাতে-কালি মুখে-কালি আমরা সেনেট-হাউস থেকে লিখে আসি। কিন্তু এতেও আমাদের শিক্ষার সাধ মেটে না। এর পরে আমরা সারাজীবন যখন যা-কিছু পড়ি–তা কবিতাই হোক আর গল্পই হোক; আমাদের মনে স্বতঃই এই প্রশ্নের উদয় হয় যে, আমরা এ পড়ে কি শিক্ষা লাভ করলম। এ প্রশ্নের উত্তর মুখে-মুখে দেওয়া অসম্ভব; কেননা, সাহিত্যের যা শিক্ষা, তা হাতে-হাতে পাওয়া যায় না। সাহিত্য যা দেয়, তা আনন্দ; কিন্তু ও-বস্তু আমরা জানি নে বলে মানি নে। আমাদের শিক্ষার ভিতর আনন্দ নেই বলে আনন্দের ভিতর যে শিক্ষা থাকতে পারে, তা আমাদের বুদ্ধির অগম্য।
ফলে, পাঠকমাত্রই যখন শিক্ষার্থী, তখন লেখকমাত্রকেই দায়ে-পড়ে শিক্ষক হতে হয়। পাঠকসমাজ যখন আমাদের কাছে শিক্ষা নিতে প্রস্তুত, তখন অবশ্য শিক্ষা দিতে আমাদের নারাজ হওয়া উচিত নয়; কেননা, লেকচারজিনিসটে দেওয়া সহজ, শোনাই কঠিন। তবে যে আমরা পাঠকদের সকল সময় শিক্ষা না দিয়ে সময়-সময় আনন্দ দেবার বৃথা চেষ্টা করে তাঁদের বিরাগভাজন হই, তার একটি বিশেষ কারণ আছে।
বাংলাসাহিত্যের যে শুধু পাঠক আছেন তা নয়, পাঠিকাও আছেন। দলে বোধ হয় উভয়েই সমান পরে হবেন, অথচ এ উভয়ের ভিতর বিদ্যার প্রভেদ বিস্তর। পাঠকেরা-সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাত্তীর্ণ; পাঠিকারা বালিকাবিদ্যালয়ের পরীক্ষাত্তীর্ণও নন। সুতরাং পাঠকদের জন্য লেখকদের পোস্টগ্র্যাজুয়েট লেকচার দেওয়া কর্তব্য, এবং পাঠিকাদের জন্য নিম্ন-প্রাইমারির। অথচ শ্রোতাদের শিক্ষা দিতে হলে আমাদের পক্ষে সেইরূপ বক্তৃতা করা আবশ্যক যা সকলের পক্ষে সমান উপযোগী হয়। অসাধ্যসাধন করবার দুঃসাহস সকলের নেই, সম্ভবত সেই কারণে বাংলার কাব্যসাহিত্য শিক্ষাদানের ভার হাতে নেয় নি।
কিন্তু এদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের পক্ষে সমান শিক্ষাপ্রদ সাহিত্য যে রচনা করা যায় না, এ ধারণা অমূলক। উপর-উপর দেখলেই এদেশের শিক্ষিত লোক এবং অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের বিদ্যাবুদ্ধির প্রভেদ মস্ত দেখায়; কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় যে, আমরা মনে সকলেই এক। মনোরাজ্যে যে আমাদের লিঙ্গভেদ নেই, বর্ণভেদ নেই, বয়োভেদ নেই তার প্রমাণ হাতে-কলমে দেখানো যেতে পারে। ‘ঘরেবাইরে’ লেখবার কৈফিয়ত তলব করে একটি ভদ্রমহিলা রবীন্দ্রনাথকে যে পত্র লিখেছিলেন, তা যে-কোনো এম. এ. পাশ-করা প্রোফেসর লিখতে পারতেন, এবং উক্ত গল্প পাঠ করে একটি এম. এ. পাশকরা প্রোফেসরের মনে যে সমস্যার উদয় হয়েছে, তা যে-কোনো ভদ্রমহিলার মনে উদয় হতে পারত। অতএব যে-কোনো শিকারী সাহিত্যিক একটি বাক্যবাণে এ দুটি পাখিকেই বিদ্ধ করতে পারেন। বস্তুগত্যা আমাদের মন হচ্ছে হরীতকী-জাতীয়; শিক্ষার গুণে সে মন পাকে না, শুধু শুকিয়ে যায়। সুতরাং বাংলার অশিক্ষিত স্ত্রীলোক ও শিক্ষিত পুরুষ–এ দুয়ের মনের ভিতর প্রভেদ এই যে, এর একটি কাঁচা আর অপরটি শুকনো। দেশসুদ্ধ লোক সেই শিক্ষা চান, যে শিক্ষার গুণে স্ত্রীপুরুষ সকলের মন সমান শুকিয়ে ওঠে। কেননা, হরীতকী যত বেশি শকোয়, যত বেশি তিতো হয়, তত বেশি উপকারী হয়। অপরপক্ষে রবীন্দ্রনাথ সেই শিক্ষার সন্ধানে ফিরছেন, যে শিক্ষার প্রভাবে আমাদের মন-হরীতকী পেকে উঠবে, এবং যার আস্বাদ গ্রহণ করে স্বজাতি অমরত্ব লাভ করবে। এক্ষেত্রে দেশের শিক্ষিতসম্প্রদায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মতের মিল হবার কোনো সম্ভাবনা নেই; কেননা, উভয়ের আদশ সম্পূর্ণ বিভিন্ন।