এ যৌবনের কপালে রাজটিকা দিতে আপত্তি করবেন, এক জড়বাদী আর এক মায়াবাদী; কারণ এরা উভয়েই একমন। এরা উভয়েই বিশ্ব হতে অস্থির প্রাণটুকু বার করে দিয়ে যে এক স্থিরতত্ত্ব লাভ করেন, তাকে জড়ই বল আর চৈতন্যই বল, সে বস্তু হচ্ছে এক, প্রভেদ যা তা নামে।
জ্যৈষ্ঠ ১৩২১
রূপের কথা
এদেশে সচরাচর লোকে যা লেখে ও ছাপায় তাই যদি তাদের মনের কথা হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা মানবসভ্যতার চরম পদ লাভ করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এই প্রকাণ্ড সত্যটা বিদেশীরা মোটেই দেখতে পায় না। এটা সত্যিই দুঃখের বিষয়। কেননা, সভ্যতারও একটা চেহারা আছে; এবং যে সমাজের সচেহারা নেই, তাকে সুসভ্য বলে মানা কঠিন। বিদেশী বলতে দু শ্রেণীর লোক বোঝায়— এক পরদেশী, আর-এক বিলেতি। আমরা যে বড়-একটা কারও চোখে পড়ি নে, সেবিষয়ে এই দুই দলের বিদেশীই একমত।
যাঁরা কালাপানি পার হয়ে আসেন, তাঁরা বলেন যে, আমাদের দেশ দেখে তাঁদের চোখ জড়োয়, কিন্তু আমাদের বেশ দেখে সে চোখ ক্ষম হয়। এর কারণ, আমাদের দেশের মোড়কে রং আছে, আমাদের দেহের মোড়কে নেই। প্রকৃতি বাংলাদেশকে যে কাপড় পরিয়েছেন, তার রং সবুজ; আর বাঙালি নিজে যে কাপড় পরেছে, তার রং, আর যেখানেই পাওয়া যাক, ইন্দ্রধনুর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা আপাদমস্তক রং-ছট বলেই অপর কারও নয়নাভিরাম নই। সুতরাং যারা আমাদের দেশ দেখতে আসে, তারা আমাদের দেখে খুশি হয় না। যাঁর বোম্বাই-শহরের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় আছে, তিনিই জানেন কলকাতার সঙ্গে সে শহরের প্রভেদটা কোথায় এবং কত জাজল্যমান। সেদেশে জনসাধারণ পথেঘাটে সকালসন্ধ্যে রঙের ঢেউ খেলিয়ে যায় এবং সে রঙের বৈচিত্র্যের ও সৌন্দর্যের আর অন্ত নেই। কিন্তু আমাদের গায়ে জড়িয়ে আছে চির-গোধুলি; তাই শুধু বিলেতি নয়, পরদেশী ভারতবাসীর চোখেও আমরা এতটা দৃষ্টিকট। বাকি ভারতবর্ষ সাজসজ্জায় স্বদেশী, আমরা আধ-স্বদেশী হাফ-বিলেতি। আর বিলেতি মতে, হয় কালো নয় শাদা–নইলে সভ্যতার লজ্জা নিবারণ হয় না। রং চাই শুধু সং সাজবার জন্যে। আমাদের নবসভ্যতাও কার্যত এই মতে সায় দিয়েছে।
২.
আপনারা বলতে পারেন যে, একথা যদি সত্যও হয়, তাতে আমাদের কি যায়-আসে। বিদেশীর মনোরঞ্জন করবার জন্য আমরা তো আর জাতকে-জাত আমাদের পরন-পরিচ্ছদ আমাদের হাল-চাল সব বদলে ফেলতে পারি নে? জীবনযাত্রা ব্যাপারটা তো আর অভিনয় নয় যে, দর্শকের মুখ চেয়ে সে-জীবন গড়তে হবে এবং তার উপর আবার রং ফলাতে হবে। একথা খুব ঠিক। জীবন আমরা কিসের জন্য ধারণ করি তা না জানলেও, এটা জানি যে, পরের জন্য আমরা তা ধারণ করি নে–অপর দেশের অপর লোকের জন্য তো নয়ই। তবে বিদেশীর কথা উত্থাপন করবার সার্থকতা এই যে, জাতীয়জীবনের একটি বিদেশীর চোখে যেমন একনজরে ধরা পড়ে, স্বদেশীর চোখে তা পড়ে না। কেননা, আজন্ম দেখে দেখে লোকের চোখে যা সয়ে গেছে, যারা প্রথম দেখে তাদের চোখে তা সয় না।
এই বিদেশীরাই আমাদের সজ্ঞান করে দিয়েছে যে, রূপ সম্বন্ধে আমরা চোখ থাকতেও কানা। আমাদের রূপজ্ঞান যে নেই, কিংবা যদি থাকে তো অতি কম, সেবিষয়ে বোধ হয় কোনো মতভেদ নেই। কেননা, এ জ্ঞানের অভাবটা আমরা জাতীয় মনের দৈন্য বলে মনে করি নে। বরং সত্যকথা বলতে গেলে, আমাদের বিশ্বাস যে, এই রূপান্ধতাটাই আমাদের জাতীয় চরিত্রের মহত্ত্বের পরিচয় দেয়। রূপ তো একটা বাইরের জিনিস; শুধু তাই নয়, বাহ্যবস্তুরও বাইরের জিনিস; ও জিনিসকে যারা উপেক্ষা, এমনকি অবজ্ঞা, করতে না শিখেছে তারা আধ্যাত্মিকতার সন্ধান জানে না। আর আমরা আরকিছু হই আর না-হই, বালবৃদ্ধবনিতা সকলেই যে আধ্যাত্মিক। সেকথা যে অস্বীকার করবে, সে নিশ্চয়ই স্বদেশ এবং স্বজাতিদ্রোহী।
৩.
রপ-জিনিসটাকে যাঁরা একটা পাপ মনে করেন, তাঁদের মতে অবশ্য রুপের প্রশ্রয় দেওয়ার অর্থ পাপের প্রশ্রয় দেওয়া। কিন্তু দলে পাতলা হলেও পৃথিবীতে এমনসব লোক আছে, যারা রূপকে মান্য করে শ্রদ্ধা করে, এমনকি পুজো করতেও প্রস্তুত; অথচ নিজেদের মহাপাপী মনে করে না। এই রূপেভক্তের দল অবশ্য স্বদেশীর কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য, অর্থাৎ প্রমাণপ্রয়োগ-সহকারে রুপের স্বত্বসাব্যস্ত করতে বাধ্য। আপসোসের কথা এই যে, যে সত্য সকলের প্রত্যক্ষ হওয়া উচিত, সেই সত্য এদেশে প্রমাণ করতে হয়— অর্থাৎ একটা সহজ কথা বলতে গেলে, আমাদের ন্যায়-অন্যায়ের স্রোতের উজান ঠেলে যেতে হয়।
যা সকলে জানে–আছে, তা নেই বলাতে অতিবন্ধির পরিচয় দেওয়া হতে পারে, কিন্তু বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা এই ‘অতি’র অতিভক্ত হওয়াতে আমাদের ইতির জ্ঞান নষ্ট হয়েছে।
বস্তুর রূপে বলে যে একটি ধর্ম আছে, এ হচ্ছে শোনা-কথা নয়। দেখাজিনিস। যাঁর চোখ-নামক ইন্দ্রিয় আছে, তিনিই কখনো-না-কখনো তার সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। এবং আমাদের সকলেরই চোখ আছে; সম্ভবত শুধু তাঁদের ছাড়া, যাঁরা সৌন্দর্যের নাম করলেই অতীন্দ্রিয়তার ব্যাখ্যান অর্থাৎ উপাখ্যান শর, করেন। কিন্তু আমি এই রূপ-জিনিসটিকে অতিবজিত ইন্দ্রিয়ের কোঠাতেই টিকিয়ে রাখতে চাই; কেননা, অতীন্দ্রিয়-জগতে রূপ নিশ্চয়ই অরূপ হয়ে যায়।
৪.
রূপের বিষয় দার্শনিকেরা কি বলেন আর না-বলেন, তাতে কিছু যায়আসে না; কেননা, যা দৃষ্টির অগোচর, তাই দর্শনের বিষয়। অতএব একথা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, বস্তুর রূপ বলে যে একটি গুণ আছে, তা মানুষমাত্রেই জানে এবং মানে। তবে সেই গুণের পক্ষপাতী হওয়াটা গুণের কি দোষের— এই নিয়েই যা মতভেদ।