২.
কেউ হয়ত প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতে পারেন, বাংলাভাষা কাকে বলে। বাঙালির মুখে এ প্রশ্ন শোভা পায় না। এ প্রশ্নের সহজ উত্তর কি এই নয় যে, যে ভাষা আমরা সকলে জানি শুনি বুঝি, যে ভাষায় আমরা ভাবনাচিন্তা সুখদুঃখ বিনা আয়াসে বিনা ক্লেশে বহুকাল হতে প্রকাশ করে আসছি, এবং সম্ভবত আরও বহুকাল পর্যন্ত প্রকাশ করব, সেই ভাষাই বাংলাভাষা? বাংলাভাষার অস্তিত্ব প্রকৃতিবাদ অভিধানের ভিতর নয়, বাঙালির মুখে। কিন্তু অনেকে, দেখতে পাই, এই অতি সহজ কথাটা স্বীকার করতে নিতান্ত কুণ্ঠিত। শুনতে পাই কোনো-কোনো শাস্ত্রজ্ঞ মৌলবি বলে থাকেন যে, দিল্লির বাদশাহ, যখন উর্দভাষা সৃষ্টি করতে বসলেন, তখন তাঁর অভিপ্রায় ছিল একেবারে খাঁটি ফারসিভাষা তৈয়ারি করা, কিন্তু বেচারা হিন্দুদের কান্নাকাটিতে কৃপাপরবশ হয়ে হিন্দিভাষার কতকগুলো কথা উর্দুতে ঢুকতে দিয়েছিলেন। আমাদের মধ্যেও হয়ত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের বিশ্বাস যে, আদিশূরের আদিপুরুষ যখন গৌড়ভাষা সৃষ্টি করতে উদ্যত হলেন, তখন তাঁর সংকল্প ছিল যে ভাষাটাকে বিলকুল সংস্কৃতভাষা করে তোলেন, শুধু গৌড়বাসীদের প্রতি পরম অনুকম্পাবশত তাদের ভাষার গুটিকতক কথা বাংলাভাষায় ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছিলেন। এখন যাঁরা সংস্কৃতবহুল ভাষা ব্যবহার করবার পক্ষপাতী, তাঁরা ঐ যে গোড়ায়-গলদ হয়েছিল তাই শুধুরে নেবার জন্যে উৎকণ্ঠিত হয়েছেন। আমাদের ভাষায় অনেক অবিকৃত সংস্কৃত শব্দ আছে, সেইগুলিকেই ভাষার গোড়াপত্তন ধরে নিয়ে, তার উপর যত পার আরও সংস্কৃত শব্দ চাপাও–কালক্রমে বাংলায় ও সংস্কৃতে দ্বৈতভাব থাকবে না; আসলে আমীলোকের কাছে এখনো নেই। মাতৃভাষার মায়ায় বদ্ধ বলে আমরা সংস্কৃত-বাংলায় অদ্বৈতবাদী হয়ে উঠতে পারছি নে। বাংলায় ফারসি কথার সংখ্যাও বড় কম নয়, ভাগ্যক্রমে ফারসিপড়া বাঙালির সংখ্যা বড় কম। নইলে সম্ভবত তাঁরা বলতেন, বাংলাকে ফারসিবল করে তোলে। মধ্যে থেকে আমাদের মা-সরস্বতী কাশী যাই কি মক্কা যাই, এই ভেবে আকুল হতেন। এক-একবার মনে হয় ও উভয়সংকট ছিল ভালো, কারণ একেবারে পণ্ডিত মণ্ডলীর হাতে পড়ে মা’র আশু কাশীপ্রাপ্তি হবারই অধিক সম্ভাবনা।
৩.
এই প্রসঙ্গে পণ্ডিতপ্রবর সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের প্রথম বক্তব্য এই যে, সাহিত্যের উৎপত্তি মানুষের অমর হবার ইচ্ছায়। যা-কিছু বর্তমান আছে, তার কুলজি লিখতে গেলেই গোড়র দিকটে গোঁজামিলন দিয়ে সারতে হয়। বড় বড় দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক, যথা শংকর স্পেন্সার প্রভৃতিও, ঐ উপায় অবলম্বন করেছেন। সুতরাং কোনো জিনিসের উৎপত্তির মূল নির্ণয় করতে যাওয়াটা বৃথা পরিশ্রম। কিন্তু একথা নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, আর যা হতেই হোক অমর হবার ইচ্ছে থেকে সাহিত্যের উৎপত্তি হয় নি। প্রথমত, অমরত্বের ঝকি আমরা সকলে সামলাতে পারি নে, কিন্তু কলম চালাবার জন্য আমাদের অনেকেরই আঙুল নিসপিস করে। যদি ভালো-মন্দ-মাঝারি আমাদের প্রতি কথা, প্রতি কাজ চিরস্থায়ী হবার তিলমাত্র সম্ভাবনা থাকত, তাহলে মনে করে দেখুন তো আমরা ক’জনে মুখ খুলতে কিংবা হাত তুলতে সাহসী হতুম। অমরত্বের বিভীষিকা চোখের উপর থাকলে, আমরা যা perfect তা ব্যতীত কিছু বলতে কিংবা করতে রাজি হতুম না। আর আমরা সকলেই মনে মনে জানি যে, আমাদের অতি ভালো কাজ, অতি ভালো কথাও perfectionএর অনেক নীচে। আসল কথা, মৃত্যু আছে বলেই বেচে সখ। পণ্যক্ষয় হবার পর আবার মত লোকে ফিরে আসবার সম্ভাবনা আছে বলেই দেবতারা অমরপুরীতে ফর্তিতে বাস করেন, তা না হলে স্বর্গও তাঁদের অসহ্য হত। সে যাই হোক, আমরা মানুষ, দেবতা নই; সুতরাং আমাদের মুখের কথা দৈববাণী হবে, এ ইচ্ছা আমাদের মনে স্বাভাবিক নয়।
দ্বিতীয়ত, যদি কেউ শুধু অমর হবার জন্য লিখব, এই কঠিন পণ করে বসেন, তাহলে সে ইচ্ছা সফল হবার আশা কত কম বুঝতে পারলে তিনি যদি বুদ্ধিমান হন তাহলে লেখা হতে নিশ্চয়ই নিবত্ত হবেন। কারণ সকলেই জানি যে হাজারে ন-শ-নিরানব্বই জনের সরস্বতী মতবৎসা। তাছাড়া সাহিত্যজগতে মড়ক অষ্টপ্রহর লেগে রয়েছে। লাখে এক বাঁচে, বাদবাকির প্রাণ দু দণ্ডের জন্যও নয়। চরক পরামর্শ দিয়েছেন, যেদেশে মহামারীর প্রকোপ সেদেশ ছেড়ে পলায়ন করাই কর্তব্য। অমর হবার ইচ্ছায় ও আশায়, কে সে রাজ্যে প্রবেশ করতে চায়?
৪.
বিদ্যাভূষণমহাশয়ের আরও বক্তব্য এই যে, জীয়ন্ত ভাষার ব্যাকরণ করতে নেই, তাহলেই নির্ঘাত মরণ। সংস্কৃত মৃতভাষা, কারণ ব্যাকরণের নাগপাশে বন্ধ হয়ে সংস্কৃত প্রাণত্যাগ করেছে। আরও বক্তব্য এই যে, মুখের ভাষার ব্যাকরণ নেই, কিন্তু লিখিত ভাষার ব্যাকরণ নইলে চলে না। প্রমাণ, সংস্কৃত শুধু অমরত্ব লাভ করেছে, পালি প্রভৃতি প্রাকৃতভাষা একেবারে চিরকালের জন্য মরে গেছে। অর্থাৎ, এককথায় বলতে গেলে, যে-কোনো ভাষারই হোক না কেন, চিরকালের জন্য বাঁচতে হলে আগে মরা দরকার। তাই যদি হয়, তাহলে বাংলা যদি ব্যাকরণের দড়ি গলায় দিয়ে আত্মহত্যা করতে চায়, তাতে বিদ্যাভূষণমহাশয়ের আপত্তি কি। তাঁর মতানুসারে তো যমের দুয়োর দিয়ে অমরপুরীতে ঢুকতে হয়। তিনি আরও বলেন যে, পালি প্রভৃতি প্রাকৃতভাষায় হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হয়েছে, কিন্তু প্রাকৃত সংস্কৃত নয় বলে পালি প্রভৃতি ভাষা লুপ্ত হয়ে গেছে। অতএব, বাংলা যতটা সংস্কৃতের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পার, ততই তার মঙ্গল। যদি বিদ্যাভূষণমহাশয়ের মত সত্য হয়, তাহলে সংস্কৃতবহুল বাংলায় লেখা কেন, একেবারে সংস্কৃতভাষাতেই তো আমাদের লেখা কর্তব্য। কারণ, তাহলে অমর হবার বিষয় আর কোনো সন্দেহ থাকে না। কিন্তু একটা কথা আমি ভালো বুঝতে পারছি নে : পালি প্রভৃতি ভাষা মত সত্য, কিন্তু সংস্কৃতও কি মত নয়? ও দেবভাষা অমর হতে পারে, কিন্তু ইহলোকে নয়। এ সংসারে মৃত্যুর হাত কেউ এড়াতে পারে না; পালিও পারে নি, সংস্কৃতও পারে নি, আমাদের মাতৃভাষাও পারবে না। তবে যে-কদিন বেচে আছে, সে-কদিন সংস্কৃতের মৃতদেহ স্কন্ধে নিয়ে বেড়াতে হবে, বাংলার উপর এ কঠিন পরিশ্রমের বিধান কেন। বাংলার প্রাণ একটুখানি, অতখানি চাপ সইবে না।