আসলে দুইজনের মুখে একই কথা। সে হচ্ছে এই যে, পরের দুঃখ যখন তাদের নিজের দোষে, তখন তাদের শুধু ভালো হতে শেখাও, তাদের দুঃখ দর করার চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য নয়। অতএব মানুষের দুর্গতির প্রতি করণ হওয়া উচিত নয়, তাদের দুর্নীতির প্রতি কঠোর হওয়াই কর্তব্য।
কিন্তু আজকাল কালের গুণে শিক্ষার গুণে আমরা পরের দুঃখ সম্বন্ধে অতটা উদাসীন হতে পারি নে, কর্মফলে আস্থা রেখে নিশ্চিন্ত থাকতে পারি নে। তাই দীনকে নীতিকথা শোনানো অনেকে হীনতার পরিচায়ক মনে করেন। ছোটছেলে সম্বন্ধে পড়লে-শুনলে দুধ-ভাতু’, এ সত্যের পরিবর্তে ‘আগে দুধভাত, পরে পড়াশনো’, এই সত্যের প্রচার করতে চাই। এদেশের দভিক্ষ-প্রপীড়িত জনগণের জন্য আমরা শিক্ষার ব্যবস্থা করবার পূর্বে অন্নের ব্যবস্থা করা শ্রেয় মনে করি। আগে অন্নপ্রাশন, পরে বিদ্যারল্ড–সংস্কারেরও এই সনাতন ব্যবস্থা বজায় রাখা আমাদের মধ্যে সংগত। অথচ আমরা যে কেন ঠিক উলটো পদ্ধতির পক্ষপাতী, তার অবশ্য কারণ আছে।
লোকশিক্ষার নামে যে আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠি, তার প্রথম কারণ যে আমরা শিক্ষিত। স্কুলে লিখে এসে যে-কালি আমরা হাত আর মুখে মেখেছি, তার ভাগ আমরা দেশসদ্ধ লোককে দিতে চাই। যেমনি একজনে লোকশিক্ষার সুর ধরেন অমনি আমরা যে তার ধুয়ো ধরি, তার আর-একটি কারণ এই যে, এ কাজে আমাদের শুধু বাক্যব্যয় করতে হয়, অর্থ ব্যয় করতে হয় না। এ ব্যাপারে লাগে লাখ টাকা, দেবে গৌরসরকার।
জনসাধারণের হাতে-খড়ি দেবার পরিবর্তে মুখে-ভাত দেবার প্রস্তাবে আমরা যে তেমন গা করি নে তার কারণ, সাংসারিক হিসাবে সকলের স্বার্থসাধন করতে গেলে নিজের স্বার্থ কিঞ্চিৎ খর্ব করা চাই; ত্যাগস্বীকারের জন্য নীতি নিজে শেখা দরকার, পরকে শেখানো দরকার নয়।
আমাদের প্রত্যেকের নিজের স্বার্থ যে সমগ্র জাতির স্বার্থের সহিত জড়িত, এ জ্ঞান যে আমাদের হয়েছে তার প্রমাণ বাংলাসাহিত্যের কতকগুলি নতুন কথায় পাওয়া যায়। ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধের কথা, জাতীয় আত্মজ্ঞানের কথা, আজকাল বক্তাদের ও লেখকদের প্রধান সম্বল। অথচ একথাও অস্বীকার করবার জো নেই যে, এত বলা-কওয়া সত্ত্বেও এই অঙ্গাঙ্গী ভাব পরস্পরের গলাগলি ভাবে পরিণত হয় নি; আর জাতীয় আত্মজ্ঞান শুধু জাতীয় অহংকারে পরিণত হচ্ছে, যদিচ অহংজ্ঞানই আত্মজ্ঞানের প্রধান শত্র। জাতীয় কত ব্যবৃদ্ধি অনেকের মনে জাগ্রত হলেও জাতীয় কর্তব্য যে সকলে করেন না, তার কারণ, পরের জন্য কিছু করবার দিন আমরা নিত্যই পিছিয়ে দিই। আমাদের অনেকের চেষ্টা হচ্ছে–প্রথমে নিজের জন্য সব করা, পরে অপরের জন্য কিছু করা। সুতরাং জাতীয় কর্তব্যটকু আর ইতিমধ্যে করা হয় না। ফলে আপনি বাঁচলে বাপের নাম’, এই পুরনো কথার উপর আমরা নিজের কর্মজীবন প্রতিষ্ঠা করি, আর ‘জাত বাঁচলে ছেলের নাম’, এইরকম একটা কোনো বিশ্বাসের বলে জাতীয় কর্তব্যের ভারটা, এখন যারা ছেলে এবং পরে যারা মানুষ হবে, তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিই।
কিন্তু আসল কথা হচ্ছে যে, যা-কিছু করতে হবে, তা ইতিমধ্যেই করতে হবে। সম্পাদকমহাশয়েরা, লেখক নয়, পাঠকদের যদি এই সত্যটি উপলব্ধি করাতে পারেন, তাহলে তাঁদের সকল অজ্ঞা আমরা পালন করতে প্রস্তুত আছি।
জ্যৈষ্ঠ ১৩২১
কথার কথা
সম্প্রতি বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে আমাদের ক্ষুদ্র সাহিত্যসমাজে একটা বড়রকম বিবাদের সূত্রপাত হয়েছে। আমি বৈয়াকরণ নই, হবারও কোনো ইচ্ছে নেই। আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরি মুসলমানরা ভস্মসাৎ করেছে বলে সাধারণত লোকে দুঃখ করে থাকে, কিন্তু প্রসিদ্ধ ফরাসি লেখক মনটেইনের মনোভাব এই যে, ও ছাই গেছে বাঁচা গেছে! কেননা, সেখানে অভিধান ও ব্যাকরণের এক লক্ষ গ্রন্থ ছিল। বাবা! শুধু কথার উপর এত কথা! আমিও মনটেইনের মতে সায় দিই। যেহেতু আমি ব্যাকরণের কোনো ধার ধারি নে, সুতরাং কোনো ঋষিঋণমুক্ত হবার জন্য এ বিচারে আমার যোগ দেবার কোনো আবশ্যক ছিল না। কিন্তু তর্ক-জিনিসটে আমাদের দেশে তরল পদার্থ, দেখতে-না-দেখতে বিষয় হতে বিষয়ান্তরে অবলীলাক্রমে গড়িয়ে যাওয়াটাই তার স্বভাব। তর্কটা শুরু হয়েছিল ব্যাকরণ নিয়ে, এখন মাঝামাঝি অবস্থায় অলংকারশাস্ত্রে এসে পৌঁছেছে, শেষ হবে বোধ হয় বৈরাগ্যে। সে যাই হোক, পণ্ডিত শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় এই মত প্রচার করেছেন যে, আমরা লেখায় যত অধিক সংস্কৃত শব্দ আমদানি করব ততই আমাদের সাহিত্যের মঙ্গল। আমার ইচ্ছে, বাংলাসাহিত্য বাংলাভাষাতেই লেখা হয়। দুর্বলের স্বভাব, নিজের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে না। বাইরের একটা আশ্রয় আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। আমরা নিজের উন্নতির জন্যে পরের উপর নির্ভর করি। স্বদেশের উন্নতির জন্যে আমরা বিদেশীর মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছি, এবং একই কারণে নিজভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্যে অপর ভাষার সাহায্য ভিক্ষা করি। অপর ভাষা যতই শ্রেষ্ঠ হোক-না কেন, তার অঞ্চল ধরে বেড়ানোটা কি মনুষ্যত্বের পরিচয় দেয়? আমি বলি, আমরা নিজেকে একবার পরীক্ষা করে দেখি না কেন। ফল কি হবে, কেউ বলতে পারে না; কারণ কোনো সন্দেহ নেই যে, সে পরীক্ষা আমরা পূর্বে কখনো করি নি। যাক ওসব বাজে কথা। আমি বাংলাভাষা ভালোবাসি, সংস্কৃতকে ভক্তি করি। কিন্তু এ শাস্ত্র মানি নে যে, যাকে শ্রদ্ধা করি তারই শ্রাদ্ধ করতে হবে। আমার মত ঠিক কিংবা শাস্ত্রীমহাশয়ের মত ঠিক, সে বিচার আমি করতে বসি নি। শুধু তিনি যে যুক্তিদ্বারা নিজের মত সমর্থন করতে উদ্যত হয়েছেন, তাই আমি যাচিয়ে দেখতে চাই।