শাস্ত্রে বলে ‘অধিকন্তু ন দোষায়’, ইংরেজিতে বলে ‘The more the merrier’। সুতরাং পর্ব-পশ্চিম যেদিক থেকেই দেখ, মাসিকপত্রের এই আধিক্যে আমাদের খুশি হবারই কথা।
তবে মাসিকপত্রের অতিবাড়বাড়াটা সাহিত্যের পক্ষে কল্যাণকর কি অকল্যাণকর, সেবিষয়ে সকলে একমত নন। স্বনামধন্য ইংরেজ লেখক অস্কার ওআইল্ডের মতে সাহিত্য এবং সাময়িক-সাহিত্য, এ দুয়ের ভিতর একটা স্পষ্ট প্রভেদ আছে। তিনি বলেন, Literature is not read এবং Journalism is unreadable
পূর্বোক্ত বচনের প্রথমাংশ যে অনেক পরিমাণে সত্য, সেকথা আমরা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য। চণ্ডীদাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যেসকল লেখক নিয়ে আমরা মহা গৌরব করি, তাঁদের রচিত কাব্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ-সম্বন্ধে যাঁর পরিচয় আছে–এমন সাহিত্যিক শতেকে জনেক মেলে কি না, সেবিষয়ে আমার বিশেষ সন্দেহ আছে।
‘লাখে না মিলল এক’–এ দুঃখের কথা, আমার বিশ্বাস, বিদ্যাপতিঠাকুর ভবিষ্যৎ-পাঠকসমাজের প্রতি লক্ষ্য করেই বলেছেন। তার পর রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে সকল সমালোচকের যে পরিচয় নেই, এর প্রমাণ আমি সম্প্রতি পেয়েছি। বঙ্গসরস্বতীর জনৈক ধনাঢ্য পণ্ঠপোষক সম্প্রতি কলিকাতার সাহিত্যসভায় এই মত ব্যক্ত করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষার দৈন্য এবং ভাবের দৈন্য গোপন করবার জন্যই মৌখিকভাষার আশ্রয় অবলম্বন করেছেন। একথা বলাও যা, আর দুয়ে-দয়ে পাঁচ করবার অক্ষমতা বশতই শ্রীযুক্ত পরাঞ্জপে দুয়ে-দয়ে চার করেন একথা বলাও তাই।
সরস্বতীর পঠপোষক হবার জন্য অবশ্য কারও তাঁর মুখদর্শন করবার কোনো দরকার নেই। তবে উক্ত সভাস্থ সমবেত বিদ্যণ্ডলী যে পূর্বোক্ত অত্যুক্তির কোনো প্রতিবাদ করেন নি, তার থেকে অনুমান করা অসংগত হবে না যে, রবীন্দ্রনাথের কাব্যের সঙ্গে সাহিত্যিক সভ্যদের কারও বিশেষ পরিচয় নেই। না-পড়ে-পণ্ডিত হওয়ায় বাঙালি তো তার অসাধারণ বুদ্ধিরই পরিচয় দেয়।
না-পড়ে-পশ্চিত হওয়া সম্ভব হলেও না-লিখে-লেখক হওয়া যায় কি না সেবিষয়ে আমার সন্দেহ আছে, এবং সেইজন্যই মাসিকপত্রের বংশবৃদ্ধিটি সুখের কিংবা দুঃখের বিষয়, সেবিষয়ে আমি মনস্থির করে উঠতে পারি নি।
সাময়িক সাহিত্য যে অপাঠ্য, অস্কার ওআইল্ডের এ মত আমাদের গ্রাহ্য করবার দরকার নেই। মাসিক সাপ্তাহিক এবং দৈনিক পত্র সম্বন্ধে অস্কার ওআইল্ড যে মত প্রকাশ করেছেন, তাঁর চাইতে ঢের বড় লেখক চার্লস ল্যাম, সাহিত্য সম্বন্ধে সেই একই মত প্রকারান্তরে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘একখানি নতুন বই প্রকাশিত হলে একখানি পরেনো বই প’ড়ো’। এর থেকে বোঝা যায় যে, সেকালের মায়ায় আমরা স্বকালের মর্যাদা বুঝতে পারি নে। কারও-কারও মতে নবসাহিত্য রচনা করা আর সরস্বতীর শ্রাদ্ধ করা একই কথা— তা মাসিকই হোক, আর সাংবৎসরিকই হোক।
তবে বইয়ের সঙ্গে মাসিকপত্রের যে একটা প্রভেদ আছে, তা আমরা সকলেই মানতে বাধ্য। বই লেখে একজনে, আর মাসিকপত্র অনেকে মিলে। এককথায়, মাসিকপত্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে সরস্বতীর বারোয়ারি পুজো করা। কাজেই ব্যাপারটা অনেক সময়ে গোলে-হরিবোলে পরিণত হয়। তার পর, যেখানে চাঁদা করে কার্য উদ্ধার করতে হয়, সেখানে জাতবিচার করা চলে না— ব্রাহণ শুদ্র সকলের পক্ষে সে উৎসবে যোগদান করবার সমান, অধিকার আছে। গোল তো এই নিয়েই।
সকলে কথা কইতে পারলেও যে গান গাইতে পারে না, হাঁটতে পারলেও যে নাচতে পারে না, একথা সকলেই জানেন এবং সকলেই মানেন। কিন্তু অনেকে লিখতে পারলেও যে লিখতে পারে না, এ জ্ঞান আমরা হারিয়ে বসে আছি।
‘হারিয়ে বসে আছি’ বলবার কারণ এই যে, সংগীতের মত লেখাজিনিসটেও যে একটি আর্ট, এ জ্ঞান আমাদের পূর্বপরিষদের ছিল। সকল আলংকারিক একবাক্যে বলে গেছেন যে, কাব্যরচনা করবার জন্য দুটি জিনিস চাই–প্রথমত, প্রাক্তন সংস্কার; দ্বিতীয়ত, শিক্ষা।
একালের অনেক লেখকের বিশ্বাস যে, সাহিত্যিক হবার জন্য একমাত্র প্রাক্তন সংস্কারই যথেষ্ট, শিক্ষা-দীক্ষার কোনোরূপ আবশ্যক নেই; কেননা, তাঁদের লেখা পড়ে বোঝা যায় না, তাঁরা তাঁদের নৈসর্গিকী প্রতিভা ব্যতীত অপর কিসের উপর নির্ভর করেন। মহর্ষি চরকের শিষ্য অগ্নিবেশ বলেছেন যে, যেসকল চিকিৎসকের গুরুর নাম কেউ জানে না, যাঁদের কোনো সতীর্থ নেই, তাঁরা ‘দ্বিজিহ্ব বায়ু-ভক্ষকাঃ’। এই শ্রেণীর সাহিত্যচিকিৎসকের দল যে ক্রমে বুদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে, সেবিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই; এবং মাসিকপত্ৰসকল এই শ্রেণীর সাহিত্যিকদের প্রশ্রয় দিতে বাধ্য।
বাংলাদেশে আজকাল যদিও বা লেখক থাকে তো লেখবার বিষয় বড়একটা নেই। লেখবার সামগ্রীর যে অনটন ঘটেছে তার প্রমাণ, আজকাল কি লেখা উচিত, কি ভাষায় লেখা উচিত, কি ধরনে লেখা উচিত— এইসব নিয়ে সকলে মহা গণ্ডগোল বাধিয়েছেন। কি শহরে, কি পাড়াগাঁয়ে, এমন মাসিকপত্র নেই, যা এই পণ্ডিতের বিচারে যোগদান করে নি।
এসকল তর্কবিতর্কের যে কোনো সার্থকতা নেই, একথা আমার মুখে শোভা পায় না। তবে এইসব আলংকারিক-তত্ত্ব নিয়ে এতটা দেশজোড়া আন্দোলন হওয়াটাই আক্ষেপের বিষয়। কেননা, এসব সমস্যার বিচার করতে হলে, প্রথমত, সে বিচার করবার শিক্ষা এবং শক্তি থাকা আবশ্যক; দ্বিতীয়ত, যুক্তিযুক্ত তর্ক করবার অভ্যাস থাকা আবশ্যক।