‘বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদা’
প্রথম-পরিচয়ে আর্যেরা যে বাঙালিজাতির সম্বন্ধে অনেক অকথা কুকথা বলেন, তার পরিচয় আমরা এ যুগেও পেয়েছি, vide Macaulay। সুতরাং প্রাচীন আর্যেরাও যে প্রথম-পরিচয়ে বাঙালিদের প্রতি নানারূপ কটু প্রয়োগ করেছিলেন, একথা সহজেই বিশ্বাস হয়। তবে এক্ষেত্রে এই সন্দেহ উপস্থিত হয় যে, যদি গালি দেওয়াই তাঁদের অভিপ্রায় ছিল, তাহলে আর্যেরা আমাদের পাখি বললেন কেন। পাখি বলে গাল দেবার প্রথা তো কোনো সভ্যসমাজে প্রচলিত দেখা যায় না। বরং বলবল’ ‘ময়না’ প্রভৃতি এদেশে আদরের ডাক বলেই গণ্য। এবং ব্যক্তিবিশেষের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হলে আমরা তাকে ‘ঘুঘু’-উপাধিদানে সম্মানিত করি। অপমান করবার উদ্দেশ্যে মানুষকে যেসব প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে, তারা প্রায়শই ভূচর এবং চতুষ্পদ, দ্বিপদ এবং খেচর নয়। পাখি বলে নিন্দা করবার একটিমাত্র শাস্ত্রীয় উদাহরণ আমার জানা আছে। বাণভট্ট তাঁর সমসাময়িক কুকবিদের কোকিল বলে ভৎসনা করেছেন; কেননা, তারা বাচাল কামকারী এবং তাদের দৃষ্টি রাগাধিষ্ঠিত’—অর্থাৎ তাদের চক্ষু, রক্তবর্ণ। গাল হিসেবে এ যে যথেষ্ট হল না— সেকথা বাণভট্টও বুঝেছিলেন; কেননা, পরবর্তী শ্লোকেই তিনি বলেছেন যে, কুকুরের মত কবি ঘরে-ঘরে অসংখ্য মেলে, কিন্তু শরভের মত কবি মেলাই দুর্ঘট। এস্থলে কবিকে প্রশংসাচ্ছলে কেন শরভ বলা হল, একথা যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, তার উত্তর, শরভ জানোয়ার হলেও চতুষ্পদ নয়, অষ্টপদ; এবং ‘তার অতিরিক্ত চারখানি পা ভূচর নয়, খেচর।
এইসব কারণে, কেবলমাত্র শব্দের সাদশ্যে থেকে এ অনুমান করা সংগত হবে না যে, আর্যঋষিরা অপর এত কড়াকড়া গাল থাকতে আমাদের পূর্বপুরুষদের কেবলমাত্র পাখি বলে গাল দিয়েছেন। শাস্ত্রীমহাশয়ের মতে আমাদের সঙ্গে মাগধ এবং চের জাতিও এ গালির ভাগ পেয়েছে। কেননা, তাঁর মতে বঙ্গ হচ্ছে বাঙালি, বগধা হচ্ছে মগধা এবং চেরপাদা হচ্ছে চের নামক অসভ্য জাতি। ‘চেরপাদা’ যে কি করে ‘চের’তে দাঁড়াল, বোঝা কঠিন। বাক্যের পদচ্ছেদের অর্থ পা কেটে ফেলা নয়। অথচ শাস্ত্রীমহাশয় ‘চেরপাদা’র পা-দুখানি কেটে ফেলেই ‘চের’ খাড়া করেছেন।
‘বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদা’— এইযুক্তপদের, শুনতে পাই, সেকেলে পণ্ডিতেরা এইরূপ পদচ্ছেদ করেন–
বঙ্গা+অবগধাঃ+চ+ইরপাদা
ইরপাদা অর্থে সাপ। তাহলে দাঁড়াল এই যে, বাঙালি ও বেহারিকে প্রথমে পাখি এবং পরে সাপ বলা হয়েছে। উক্ত বৈদিক নিন্দার ভাগ আমি বেহারিদের দিতে পারি নে। অবগধা মানে যে মাগধ, এর কোনো প্রমাণ নেই। অতএব শাস্ত্রীমহাশয় যেমন ‘চেরপাদা’র শেষ দুই বর্ণ ছেটে দিয়ে ‘চের’ লাভ করেছেন, আমিও তেমনি ‘অবগধা’ শব্দের প্রথম দুটি বর্ণ বাদ দিয়ে পাই ‘গধা’। এইরূপ বর্ণবিচ্ছেদের ফলে উক্ত বচনের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, আর্যঋষিদের মতে বাঙালি আদিতে পক্ষী, অন্তে সর্প এবং ইতিমধ্যে গর্দভ।
‘অবগধা’কে ‘গধা’য় রুপান্তরিত করা সম্বন্ধে কেউ-কেউ এই আপত্তি উত্থাপন করতে পারেন যে, সেকালে যে গাধা ছিল তার কোনো প্রমাণ নেই। শাস্ত্রীমহাশয় বাঙালির প্রথম গৌরবের কারণ দেখিয়েছেন যে, পরাকালে বাংলায় হাতি ছিল, কিন্তু বাঙালির দ্বিতীয় গৌরবের এ কারণ দেখান নি যে, সেকালে এদেশে গাধাও ছিল। কিন্তু গাধা যে ছিল, এ অনুমান করা অসংগত হবে না। কেননা, যদি সেকালে গাধা না থাকত তো একালে এদেশে এত গাধা এল কোথা থেকে। ঘোড়া যে বিদেশ থেকে এসেছে, তার পরিচয় ঘোড়ার নামেই পাওয়া যায়; যথা পগেয়া ভুটিয়া তাজি আরবি ইত্যাদি। কিন্তু গর্দভদের এরূপ কোনো নামরূপের প্রভেদ দেখা যায় না। এবং ও জাতি যে যে-কোনো অর্বাচীন যুগে বঙ্গদেশে এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছে, তারও কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে, রাসভকুল অপর সকল দেশের ন্যায় এদেশে এখনও আছে, পূর্বেও ছিল। তবে একমাত্র নামের সাদশ্য থেকে এরূপ অনুমান করা অসংগত হবে যে, আর্যঋষিরা পুরাকালের বাঙালিদের এরূপ তিরস্কারে পুরস্কৃত করেছেন। সংস্কৃতভাষায় ‘বঙ্গ’ শব্দের অর্থ বক্ষ। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, আরণ্যকশাস্ত্রে বক্ষ পক্ষী সর্প প্রভৃতি আরণ্য জীবজন্তুরই উল্লেখ করা হয়েছে, বাঙালির নামও করা হয় নি। অতএব আমাদের অতীত অতি গৌরবেরও বস্তু নয়, অতি অগৌরবেরও বস্তু নয়।।
আর-একটি কথা। হীরেন্দ্রবাবু দর্শন-শব্দের, এবং যোগেশবাবু বিজ্ঞানশব্দের নিরুক্তের আলোচনা করেছেন, কিন্তু যদুবাবু ইতিহাসের নিরুক্ত সম্বন্ধে নীরব। ইতিহাস-শব্দ সম্ভবত হস্ ধাতু হতে উৎপন্ন, অন্তত শাস্ত্রীমহাশয়ের ইতিহাস যে হাস্যরসের উদ্রেক করে, সেবিষয়ে আর-কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি, আমার সময়ে সময়ে মনে হয় যে, শাস্ত্রীমহাশয় পুরাতত্ত্বের ছলে আত্মশ্লাঘাপরায়ণ বাঙালিজাতির সঙ্গে একটি মস্ত রসিকতা করেছেন।
জ্যৈষ্ঠ ১৩২২
টীকা ও টিপ্পনি
শ্ৰীযুক্ত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মহাশয় সম্প্রতি দুঃখ করে বলেছেন যে, সেকালে সবে তিন-চারখানি মাসিকপত্র ছিল এবং তার একখানিও মাসে-মাসে বেরত না; থেকে-থেকেই তার একটি-না-একটি বিনা-নোটিশে বন্ধ হয়ে যেত।
এ দুঃখ আমাদের নেই। একালে অন্তত এমন ত্রিশ-চল্লিশখানি মাসিকপত্র আছে যা মাসে-মাসে বেরয়, আর তার একখানিও বন্ধ হয়ে যায় না।