‘অবিনাশিনমগ্ৰাম্যমকরোৎসাতবাহনঃ।
বিশুদ্ধ জাতিভিঃ কোশং রঙ্গৈরিব সুভাষিতৈঃ॥
তারপর ভর্তৃহরি যে একন’র পান্না এক-ন’র চুনি এবং এক-ন’র নীলা–এই তিন-ন’র রত্নমালা সরস্বতীর কণ্ঠে পরিয়ে গেছেন, তার প্রতি-রত্নটি যে বিশুদ্ধজাতীয় এবং অবিনাশী, তার আর সন্দেহ নেই। যাবচ্চন্দ্রদিবাকর এই তিন শত বর্ণোজ্জল লোক সরস্বতীর মন্দির অহর্নিশি আলোকিত করে রাখবে।
আসল কথা, চুটকি যদি হয় হয়, তাহলে কাব্যের চুটকিত্ব তার আকারের উপর নয় তার প্রকারে অথবা বিকারের উপর নির্ভর করে, নচেৎ সমগ্ৰ সংস্কৃত কাব্যকে চুটকি বলতে হয়। কেননা, সংস্কৃতভাষায় চার ছত্রের বেশি কবিতা নেই কাব্যেও নয় নাটকেও নয়। শুধু কাব্য কেন, হাতে-বহরে বেদও চুটকির অন্তর্ভূত হয়ে পড়ে। শাস্ত্রমহাশয় বলেন যে, বাঙালি-ব্রাহ্মণ বুদ্ধিমান ব’লে বেদাভ্যাস করেন না। কর্ণবেধের জন্য যতটুকু বেদ দরকার, ততটুকুই এদেশে ব্রাহ্মণসন্তানের করায়ত্ত। অথচ বাঙালি বেদপাঠ না করেও একথা জানে যে, ঋক হচ্ছে ছোটকবিতা এবং সাম গান। সুতরাং আমরা যখন ছোটকবিতা ও গান রচনা কবি, তখন আমরা ভারতবর্ষের কাব্যরচনার সনাতন রীতিই অনুসরণ করি।।
শাস্ত্রীমহাশয় মুখে যাই বলুন, কাজে তিনি চুটকিরই পক্ষপাতী। তিনি আজীবন চুটকিতেই গলা সেধেছেন, চুটকিতেই হাত তৈরি করেছেন, সুতরাং কি লেখায়, কি বক্তৃতায়, আমরা তাঁর এই অভ্যস্ত বিদ্যারই পরিচয় পাই। তিনি বাঙালির যে বিংশপর্ব মহাগৌরব রচনা করেছেন, তা ঐতিহাসিক চুটকি বই আর কিছুই নয়; অন্তত সে রচনাকে শ্রীযুক্ত যদুনাথ সরকার মহাশয় অন্য কোননা নামে অভিহিত করবেন না।
একথা নিশ্চিত যে, তিনি সরকারমহাশয়ের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেন নি, সম্ভবত এই বিবাসে যে, বৈজ্ঞানিকপদ্ধতি অনুসারে আবিষ্কৃত সত্য বাঙালির পক্ষে পুষ্টিকর হতে পারে, কিন্তু রুচিকর হবে না। সরকারমহাশয় বলেন যে, এদেশের ইতিহাসের সত্য যতই অপ্রিয় হোক বাঙালিকে তা বলতেও হবে, শুনতেও হবে। অপরপক্ষে শাস্ত্রীমহাশয়ের উদ্দেশ্য তাঁর রচনা লোকের মুখরোচক করা, এবং সেই উদ্দেশ্য সাধন করবার জন্য তিনি নানারকম সত্য ও কল্পনা একসঙ্গে মিলিয়ে ঐতিহাসিক সাড়ে-বত্রিশ-ভাজার সৃষ্টি করেছেন। ফলে এ রচনায় যে মাল আছে, তাও মশলা থেকে পথক করে নেওয়া যায় না। শাস্ত্রীমহাশয়ের কথিত বাংলার পারাবত্তের কোনো ভিত্তি আছে কি না বলা কঠিন। তবে এ ইতিহাসের যে গোড়াপত্তন করা হয় নি, সেবিষয়ে আর দ্বিমত নেই। ইতিহাসের ছবি আঁকতে হলে প্রথমে ভূগোলের জমি করতে হয়। কোনোএকটি দেশের সীমার মধ্যে কালকে আবদ্ধ না করতে পারলে সে-কালের পরিচয় দেওয়া যায় না। অসীম আকাশের জিওগ্রাফি নেই, অনন্ত কালেরও হিস্টরি নেই। কিন্তু শাস্ত্রীমহাশয় সেকালের বাঙালির পরিচয় দিতে গিয়ে সেকালের বাংলার পরিচয় দেন নি, ফলে গৌরবটা উত্তরাধিকারী-স্বত্বে আমাদের কি অপরের প্রাপ্য এবিষয়েও সন্দেহ থেকে যায়। শাস্ত্রীমহাশয়ের শক্ত হাতে পড়ে দেখতে পাচ্ছি অঙ্গ ভয়ে বঙ্গের ভিতর সেধিয়েছে; কেননা, যে ‘হস্ত্যায়বেদ’ আমাদের সর্বপ্রথম গৌরব, সে শাস্ত্র অঙ্গরাজ্যে রচিত হয়েছিল। বাংলার লম্বাচৌড়া অতীতের গণবর্ণনা করতে হলে বাংলাদেশটাকেও একটু লম্বাচৌড়া করে নিতে হয়, সম্ভবত সেইজন্য শাস্ত্রীমহাশয় আমাদের পূর্বপুরুষদের হয়ে অঙ্গকেও বেদখল করে বসেছেন। তাই যদি হয়, তাহলে বরেন্দ্রভূমিকে ছেটে দেওয়া হল কেন। শুনতে পাই, বাংলার অসংখ্য প্রত্নরাশি বরেন্দ্রভূমি নিজের বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছে। বাংলার পূর্বগৌরবের পরিচয় দিতে গিয়ে বাংলার যে ভূমি সবচেয়ে প্রত্নগর্ভা, সে প্রদেশের নাম পর্যন্ত উল্লেখ না করবার কারণ কি। যদি এই হয় যে, পূর্বে উত্তরবঙ্গের আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল না, এবং থাকলেও সেদেশ বঙ্গের বহির্ভূত ছিল, তাহলে সেকথাটাও বলে দেওয়া উচিত। নচেৎ বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি আমাদের মনে একটা ভুল ধারণা এমনি বদ্ধমূল করে দেবে যে, তার ‘আমল পরিবর্তন’ কোনো চুটকি ইতিহাসের দ্বারা সাধিত হবে না।
শাস্ত্রীমহাশয় যে তাম্রশাসনে শাসিত নন, তার প্রমাণ তিনি পাতায় পাতায় বলেন, ‘আমি বলি’ ‘আমার মতে’ এই সত্য। এর থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, শাস্ত্রীমহাশয়ের ইতিহাস বস্তুতন্ত্রতার ধার ধারে না, অর্থাৎ এককথায় তা কাব্য; এবং যখন তা কাব্য, তখন তা যে চুটকি হবে, তাতে আর আশ্চর্য কি।
শাস্ত্রীমহাশয়ের, দেখতে পাই, আর-একটি এই অভ্যাস আছে যে, তিনি নামের সাদশ্য থেকে পৃথক-পথক বস্তু এবং ব্যক্তির ঐক্য প্রমাণ করেন। একীকরণের এ পদ্ধতি অবশ্য বৈজ্ঞানিক নয়। কৃষ্ট এবং খষ্ট, এ দুটি নামের যথেষ্ট সাদশ্য থাকলেও ও দুটি অবতারের প্রভেদ শুধু বর্ণগত নয়, বগগতও বটে। কিন্তু শাস্ত্রীমহাশয়ের অবলম্বিত পদ্ধতির এই একটি মহাগুণ যে, ঐ উপায়ে অনেক পর্বগৌরব আমাদের হাতে আসে, যা বৈজ্ঞানিক হিসেবে ন্যায়ত অপরের প্রাপ্য। কিন্তু উক্ত উপায়ে অতীতকে হস্তান্তর করার ভিতর বিপদও আছে। একদিকে যেমন গৌরব আসে, অপরদিকে তেমনি অগৌরবও আসতে পারে। অগৌরব শুধু যে আসতে পারে তাই নয়, বস্তুত এসেছে।
স্বয়ং শাস্ত্রীমহাশয় ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ হতে এই সত্য উদ্ধার করেছেন যে, প্রাচীন আর্যেরা বাঙালিজাতিকে পাখি বলে গালি দিতেন। সে বচনটি এই–