শেষকালে আমরা দুই উন্মত্ত জ্যোতির্বিদের মত নীল কৃষ্ণ ধূসর পিঙ্গল পাটল চক্ষুতারকার জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যে স্নিগ্ধ তীব্র রুষ্ট তুষ্ট স্থির চঞ্চল বিচিত্র রশ্মিজালে একেবারে নিরুদ্দেশ হইয়া গেলাম। যে সকল নব নব রহস্য আবিষ্কার করিতেছিলাম, তাই কোন চক্ষুতত্ত্বে কোন অপটিস্ শাস্ত্রে আজ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হয় নাই।
আমরা পাঠিকাদের নিকট মার্জনা প্রার্থনা করি। আমাদের রচনার অক্ষর পংক্তি ভেদ করিয়া তাহাদের বিচিত্র নেত্রের বিচিত্র অদৃশ্য আঘাত আমরা অনুভব করিতেছি। স্বীকার করি, তাঁহাদের চক্ষুতার। বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের বিষয় নহে, দর্শনশাস্ত্রও সেখানে অন্ধ হইয়া যায়; পণ্ডিত অ্যাবেলার্ড তাহার প্রমাণ দিয়াছেন। আমরা অল্পবয়সের দুঃসাহসে যাহা করিয়াছি তাহা অদ্য স্মরণ হইলে হৃৎকম্প হয়। কেন যে হৃৎকম্প হয় নিম্নে তাহার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করিলাম।
পূর্বেই বলিয়াছি, তরুণ বয়স এবং বসন্ত কালের গতিকে সবশুদ্ধ অত্যন্ত হালকা বোধ করিতেছিলাম। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে যাহারা অভ্যস্ত তাহারা যদি হঠাৎ একটা ক্ষুদ্র গৃহে গিয়া ওঠে, সেখানে যেমন পা ফেলিতে গেলে হঠাৎ প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া যায়, পদে পদে তেতালার ছাদে এবং মনুমেন্টের চূড়ার উপরে উঠিয়া পড়ে আমাদের সেই দশা হইয়াছিল। শিষ্ট সমাজের মাধ্যাকর্ষণ-বন্ধন হইতে আমরা ছুটি লইয়াছিলাম,—সেইজন্য একটু পা তুলিতে গিয়া একেবারে প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া পড়িতেছিলাম।
এখন সুন্দর মুখ দেখিবামাত্র বিনা চিন্তায়, বিনা চেষ্টায় মুখ দিয়া আপনি বাহির হইয়া পড়ে “বাঃ দিব্য!” এইরূপে নিজের অজ্ঞাতসারে টপ করিয়া শিষ্টাচারের ওপারে গিয়া উপনীত হইতাম। ওপারে যে সর্বত্র নিরাপদ নহে একদিন তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম।
সেদিন আমরা একটু অসময়ে পার্কে গিয়াছিলাম। গিয়া দেখিলাম, যাহা একের পক্ষে অসময় তাহা অন্যের পক্ষে উপযুক্ত সময়। জনসাধারণ পার্কে যায় জনসাধারণের আকর্ষণে; কিন্তু জনবিশেষ পার্কে যায় জনবিশেষের প্রলোভনে। উভয়ের মধ্যে স্বভাবতঃই একটা সময়ের ভাগাভাগি হইয়া গেছে।
সেদিন তখনো জনসমাগমের সময় হয় নাই। যাহারা আসিয়াছিল তাহারা সমাজপ্রিয় নহে; বহুজনতা অপেক্ষা একজনতা তাহারা পছন্দ করে; এবং সেইরূপ পছন্দমত একজন লইয়া তাহারা যুগলরূপে নিকুঞ্জছায়ায় সঞ্চরণ করিতেছিল।
আমরা ঘুরিতে ঘুরিতে এমনি একটি যুগলমূর্তির কাছে গিয়া পড়িয়াছিলাম। বোধ হইল তাহারা নবপরিণীত, পরস্পরের দ্বারা এমনি আবিষ্ট যে অনুচর কুকুরটি প্রভুদম্পতির সোহাগের মধ্য হইতে নিজের অতি তুচ্ছ অংশটুকু দাবী করিবার অবকাশমাত্র পাইতেছে না।
পুরুষটি পুরুষ বটে। তাহার শরীরগঠনে প্রকৃতির কৃপণতামাত্রই ছিল না। দৈর্ঘ্যপ্রস্থ বক্ষ বাহু রক্তমাংস অস্থি ও পেশী অত্যন্ত অধিক। আর তাহার সঙ্গিনীটিতে শরীরাংশ একান্ত কম করিয়া তাহাকে কেবল নীলে লালে শুভ্রে, কেবল বর্ণে এবং গঠনে, ভাবে এবং ভঙ্গীতে, কেবল চলা এবং ফেরায় গড়িয়া তোলা হইয়াছে। তাহার গ্রীবার ডৌলটুকু, কপোলের টোলটুকু, চিবুকের গোলটুকু, কর্ণরেখার অতি সুকুমার আবর্তনটুকু, তাহার মুখশ্রীর যেখানে সরল রেখা অতি ধীরে বক্তৃতায় এবং বক্ররেখা অতি যত্নে গোলতে পরিণত হইয়াছে সেই রেখাভঙ্গের মধ্যে প্রকৃতির একটি উচ্ছ্বসিত বিস্ময় যেন সম্পূর্ণ অবাক হইয়া আছে।
আমাদেরও উচিত ছিল প্রকৃতির সেই পথ অবলম্বন করা। পুরুষটির প্রতি কিঞ্চিৎ লক্ষ্য রাখিলেই তাহার সঙ্গিনীর প্রতি বিস্ময়োচ্ছাস আপনি নির্বাক হইয়া আসে, কিন্তু আমাদের অভ্যাস খারাপ হইয়াছিল,মুহূত মধ্যে বলিয়া উঠিলাম, “বাঃ দিব্য দেখিতে?” দেখিলাম দ্রুত লজ্জায় কন্যাটির শুভ্র ললাট অরুণবর্ণ হইয়া উঠিল, চকিতের মধ্যে একবার আমার দিকে ত্রস্ত বিস্মিত নেত্ৰপাত করিয়াই আয়ত নেত্ৰদুটি সে অন্যদিকে ফিরাইয়া লইল। আমরাও এ সম্বন্ধে দ্বিতীয় চিন্তা না করিয়া মৃদু পদচারণায় হাওয়া খাইতে লাগিলাম।
এমন সময় পেট ভরিয়া হওয়া খাইবার আসন্ন ব্যাঘাত সম্ভাবনা দেখা গেল। কিয়দ্দূরে গিয়া সেই দম্পতি-যুগলের মধ্যে একটা কি কপাতা হইল; মেয়েটি সেইখানে দাড়াইয়া রহিল; তাহার অপরিমিত স্বামীটি প্রকাণ্ড ক্রুদ্ধ বৃষভের মত মাথা নীচু করিয়া গল্প করিয়া আমার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। তাহার তপ্ত অঙ্গারের মত মুখ দেখিয়া আমার বন্ধু সহসা নিকটস্থ তরুলতার মধ্যে কোন এক জায়গায় দুর্লভ হইয়া উঠিলেন।
দেখিলাম মেয়েটিও উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিয়াছে—এই বঙ্গসন্তানের প্রতি তাহার স্বামীটিকে চালনা করা ঠিক উপযুক্ত হয় নাই তাহা সে বুঝিতে পারিয়াছিল, কিন্তু শক্তিশেল একবার যখন মারমূর্তি ধরিয়া ছোটে তখন তাহাকে প্রত্যাহার করিবে কে? – আমি দাড়াইয়া রহিলাম। জনপুঙ্গব আমার সম্মুখে আসিয়া গুরুগর্জনে বলিলেন “কি মহাশয়!” ক্রোধে তাহার বাক্যস্ফুর্তি দুরূহ হইয়া পড়িয়াছিল।
আমি গম্ভীর স্থির স্বরে কহিলাম “কেন মহাশয়!”
ইংরাজ কহিল “আপনি যে বলিলেন “দিব্য দেখিতে” তাহার মানে কি?”
আমি তাহার তপ্ত তাম্রবর্ণ মুখের প্রতি শান্ত কটাক্ষপাত করিয়া ঈষৎ হাসিয়া কহিলাম—”তাহার মানে আপনার কুকুরটি দিব্য দেখিতে!”