- বইয়ের নামঃ প্রমথ চৌধুরীর গল্পসংগ্রহ
- লেখকের নামঃ প্রমথ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
প্রবাস-স্মৃতি
তখন আমি অক্সফোর্ডে। শীতপগমে নববসন্তের সঞ্চার হইয়াছে। অভিভাবকেরা রাগ করিতে পারেন, কিন্তু বসন্তকাল পড়াশুনার জন্য হয় নাই। পৃথিবীতে বরাবর যে ছয়টা করিয়া ঋতু পরিবর্তন প্রচলিত হইয়া আসিয়াছে তাহার কি প্রয়োজন ছিল, যদি সকল ঋতুতেই কতশ পালন করিতে হইবে!
ফাঁকি দেবার একটা সময় আছে, ভাল ছেলেরা সেটা বোঝে না। তারা শীতবসন্ত মানিয়া চলে না এমনি কাণ্ডজ্ঞানবিহীন। একদিন পূর্ণিমারাত্রে শেক্সপীয়রের নাটকে কোন এক নরনারাযুগল বলিয়াছিল, এমন রাত্রি নিদ্রার জন্য হয় নাই। কিন্তু কবির নাটকে স্থান পায় নাই এমন অনেক নরনারীযুগল আছে যাহারা প্রতিরাত্রেই ঘুমায়। তাহাদের শরীর দিবা সুস্থ থাকে। কিন্তু পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া যাহাদের কাছে পৃর্ণিমা অমাবস্যা চিরদিন সমান রহিয়া গেল, অত্যন্ত সুস্থ শরীরটাকে সুদীর্ঘকাল বহন করিয়া তাহাদের লাভ কি?
যাহাই হৌক, ভালমন্দ বিচারের বয়স এখনো আমাদের হয় নাই; যখন কতব্য অকতন্য দুটোই এক রকম সমাধা হইয়া যাইবে তখন বেকার বসিয়া বিচারের সময় পাওয়া যাইবে। আপাততঃ সেদিন প্রবাসে যখন রুদ্ধ বোতলের মত মেঘান্ধকার শীতের কালো ছিপিটা ছুটাইয়া সূর্যকিরণ স্বর্ণবর্ণ সুরাস্রোতের মত উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছিল এবং সমস্ত আকাশভরা একটি অনির্বচনীয় উত্তাপ ও গন্ধ কেন এক অনির্দিষ্ট অথচ অন্তরতম সজীব পরিবেষ্টনের মত চতুর্দিককে নিবিড় করিয়া রাখিয়াছিল সেদিন আমরা কিছুকাল পূরা ছুটি লইয়াছিলাম।
আমরা দুই বন্ধুতে অক্সফোর্ড পার্কে বেড়াইতে গিয়াছি। কোন উদ্দেশ্য বা সাধনা লইয়া বাহির হই নাই। কিন্তু পদে পদে সিদ্ধিলাভ করিব এমন বিশ্বাস ছিল। অর্থাৎ যাহাই হাতের কাছে আসিবে তাহাই প্রচুর হইয়া উঠিবে, সেদিনকার জলের স্থলের ভাবখানা এমনিতর ছিল।
পার্কে সেদিন সৌন্দর্যসত্ৰ বসিয়াছিল। সে সৌন্দর্য কেবল লতাপাতার নহে। সত্য কথা বলিতে কি, যে কোন ঋতুতেই হোক উদ্ভিজ্জ পদার্থের দিকে আমাদের তেমন আসক্তি নাই; তৃণগুল্মের সর্বপ্রকার স্বত্ব আমরা কবিজাতি বা যে কোন জাতির জন্য সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে ছাড়িয়া দিতে পারি।
আমরা তখন অবোধ ছাত্র ছিলাম, এবং স্ত্রীসৌন্দর্যের প্রতি আমাদের কিছু পক্ষপাত ছিল। হায়! এখন বুদ্ধি বাড়িতেছে তবু তাহা কাটাইয়া উঠিতে পারি নাই।
সেদিন পুরনারীরা পার্কে বাহির হইয়াছিলেন। কেবল যে মেঘমুক্ত সূর্যকিরণের প্রলোভনে তাহা বোধ হয় না। আমাদের মত পক্ষপাতীদের নেত্রপাতও সূর্যকিরণের মত অতপ্ত এবং সুখসেব্য। তাঁহারা বসন্তের বনপথে নিজের সমস্ত বর্ণচ্ছটা উন্মীলিত করিয়া বেড়াইতেছিলেন। সে কি শুদ্ধমাত্র লতাপাতা এবং রৌদ্রবায়ুর অনুরাগে? আশা করি তাহা নহে।
আমাদের চক্ষের দুটি কালো তারা কালো ভৃঙ্গের মত একমুখ হইতে আর এক মুখের দিকে উড়িতেছিল। তাহার কোন শৃঙ্খলা কোন নিয়ম, কোন দিগ্বিদিক্ জ্ঞানমাত্র ছিল না।
এমন সময় আমার পার্শ্বস্থ বন্ধু অনুচ্চস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “বাঃ, দিব্য দেখিতে।” বসন্তের একটা আচমকা নিঃশ্বাস ঠিক যেমন একেবারে ফুলের উপরে গিয়া পড়ে, তাহার বৃন্তটি অল্প একটু দোলা পায়, তাহার গন্ধ অমনি একটু উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, তেমনি আমার বন্ধুর আত্মবিস্মৃত বাহবাটুকু ঠিক জায়গায় ঠিক পরিমাণে আঘাত দিয়াছিল। তরুণী পান্থনারী চকিত বিচলিত গ্রীবা হেলাইয়া স্মিতহাস্যে আমার সৌভাগ্যবান বন্ধুর প্রতি তাহার উজ্জ্বল নীল নেত্রের একটুখানি প্রসাদবৃষ্টি করিয়া গেল।
আমি বলিলাম, এ ত মন্দ নহে। সময়ের সদ্ব্যবহার করিবার একটা উপায় পাওয়া গেল। আজ নারীহৃদয়ের, স্পেক্টম অ্যানালিসিস, রশ্মি বিশ্লেষণ করিয়া দেখা যাক। কাহার মধ্য হইতে কি রঙের ছটা বাহির হয় সেটা কৌতুকাবহ পরীক্ষার বিষয় বটে।।
পরীক্ষা শুরু হইল এবং ছটা নানা রকমের বাহির হইতে লাগিল। চলিতে চলিতে যাহাকে চোখে ধরে বলিয়া উঠি, বাঃ দিব্য।
অমনি কেহ বা চট করিয়া খুসি হইয়া উঠে; প্রগল্ভ আনন্দের প্রকাশ্য হাসি একেবারে এক নিমেষে মুখচক্ষুর সমস্ত কোণ উপকোণ হইতে ঠিকরিয়া বাহির হয়। কাহারো বা লজ্জায় গ্রীবামূল পর্যন্ত – রক্তিম হইয়া উঠে; দ্রুত চকিত হৃৎপিণ্ড খামকা অনাবশ্যক উদ্বেগে দুটি কর্ণপ্রান্ত এবং শুভ্র কপোলকে উত্তপ্ত উদ্দীপ্ত করিয়া তোলে; লজ্জাবতী নম্রশিরে, তরুণ হরিণীর মত, মুগ্ধদৃষ্টির তীক্ষ্ণ লক্ষ্য হইতে আপনাকে কোনমতে বাঁচাইয়া চলিয়া যায়। কাহারো বা মুখে এককালে দুই ভবের দ্বন্দ উপস্থিত হয়, ভালও লাগে অথচ ভাল লাগা উচিত নয় এটাও মনে হয়; দুই বিপরীত তরঙ্গ পরস্পরকে ব্যর্থ করিয়া দেয়; খুসিও ফোটে না, বিরক্তিকেও যথোচিত অকৃত্রিম দেখিতে হয় না। কিন্তু কোন কোন মহীয়সী মহিলা অপমানদংশিত দ্রুতবেগে দৃঢ় পদক্ষেপে পপের অপর পার্শ্বে চলিয়া গেছেন, তাহাদের জুলভড়িৎ, রোষকটাক্ষপাত হইতেও আমরা বঞ্চিত হইয়াছি। আবার কোন কোন তেজস্বিনীর দুইটি দীপ্ত কালো চক্ষু, ভুল বানানের উপর প্রচণ্ড পরীক্ষকের কালো পেন্সিলের মত, আমাদের দুজনার মাথা হইতে পা পর্যন্ত সজোরে দুইটা কালো লাঞ্ছনার দাগ টানিয়া দিয়াছে, ক্ষণকালের জন্য আমাদের মনে হইয়াছে যেন বিধাতার রচনা হইতে আমরা এক দমে কাটা পড়িলাম।