এই কথা শুনে সে একটু গম্ভীর হয়ে গেল। পাঁচমিনিট চুপ করে থেকে বললে—”তুমি কি ভাবছ যে তুমি পৃথিবীর পথে আমার পিছু পিছু চিরকাল চলতে পারবে?”
—”আমার বিশ্বাস পারব।”
—”আমি তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি তা না জেনে?”
–”তোমার আলোই আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।”
।
—”আমি যদি আলেয়া হই! তাহলে তুমি একদিন অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে শুধু কেঁদে বেড়াবে।”
আমার মনে এ কথার কোনও উত্তর জোগাল না। আমি নীরব হয়ে গেলুম দেখে সে বললে—”তোমার মুখে এমন-একটি সরলতার চেহারা আছে যে, আমি বুঝতে পাচ্ছি তুমি এই মুহূর্তে তোমার মনের কথাই বলছ। সেই জন্যই আমি তোমার জীবন আমার সঙ্গে জড়াতে চাইনে। তাতে শুধু কষ্ট পাবে। যে কষ্ট আমি বহু লোককে দিয়েছি, সে কষ্ট আমি তোমাকে দিতে চাইনে;—প্রথমতঃ তুমি বিদেশী, তারপর তুমি নিতান্ত অর্বাচীন।”
এতক্ষণে আমরা Oxford Circus-এ এসে পৌঁছলুম। আমি একটু উত্তেজিত ভাবে বললুম—”আমি নিজের মন দিয়ে জানছি যে, তোমাকে হারানোর চাইতে আমার পক্ষে আর কিছু বেশী কষ্ট হতে পারে না। সুতরাং তুমি যদি আমাকে কষ্ট না দিতে চাও, তাহলে বল আবার কবে আমার সঙ্গে দেখা করবে।”
সম্ভবতঃ আমার কথার ভিতর এমন একটা কাতরতা ছিল, যা তার মনকে স্পর্শ করলে। তার চোখের দিকে চেয়ে বুঝলুম যে, তার মনে আমার প্রতি একটু মায়া জন্মেছে। সে বল্লে—”আচ্ছা তোমার কার্ড দাও, আমি তোমাকে চিঠি লিখব।”
আমি অমনি আমার পকেট-কেস্ থেকে একখানি কার্ড বার করে তার হাতে দিলুম। তারপর আমি তার কার্ড চাইলে সে উত্তর দিলে–“সঙ্গে নেই।” আমি তার নাম জানবার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করলুম, সে কিছুতেই বলতে রাজি হল না। শেষটা অনেক কাকুতি-মিনতি করবার পর বললে—”তোমার একখানি কার্ড দাও, তার গায়ে লিখে দিচ্ছি; কিন্তু তোমার কথা দিতে হবে সাড়ে-ছটার আগে তুমি তা দেখবে না।”
তখন ছটা বেজে বিশ মিনিট। আমি দশ মিনিট ধৈর্য ধরে থাকতে প্রতিশ্রুত হলুম। সে তখন আমার পকেট-কেসটি আমার হাত থেকে নিয়ে, আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে, একখানি কার্ড বার করে তার উপর পেন্সিল দিয়ে কি লিখে, আবার সেখানি পকেট-কেসের ভিতর রেখে, কেসটি আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়েই, পাশে যে ক্যাবখানি দাঁড়িয়ে ছিল তার উপর লাফিয়ে উঠে সোজা মার্বেল আর্চের দিকে হাঁকাতে বললে। দেখতে-না-দেখতে ক্যাবখানি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি Regent Street-এ ঢুকে, প্রথম যে restaurant চোখে পড়ল তার ভিতর প্রবেশ করে, এক পাইন্ট শ্যাম্পেন নিয়ে বসে গেলুম। মিনিটে মিনিটে ঘড়ি দেখতে লাগলুম। দশমিনিট দশঘণ্টা মনে হল। যেই সাড়ে-ছটা বাজা, অমনি আমি পকেট-কেস্ খুলে যা দেখলুম, তাতে আমার ভালবাসা আর শ্যাম্পেনের নেশা একসঙ্গে ছুটে গেল। দেখি কাডখানি রয়েছে, গিনি কটি নেই! কার্ডের উপর অতি সুন্দর স্ত্রীহস্তে এই কটি কথা লেখা ছিল—
“পুরুষমানুষের ভালবাসার চাইতে তাদের টাকা আমার ঢের বেশি আবশ্যক। যদি তুমি আমার কখনও খোঁজ না কর, তাহলে যথার্থ বন্ধুত্বের পরিচয় দেবে।” আমি অবশ্য তার খোঁজ নিজেও করি নি, পুলিশ দিয়েও করাইনি। শুনে আশ্চর্য হবে, সেদিন আমার মনে রাগ হয়নি, দুঃখ হয়েছিল,–তাও আবার নিজের জন্য নয়, তার জন্য।
৪. সোমনাথের কথা
সোমনাথ এতক্ষণ, যেমন তার অভ্যাস, একটির পর আর একটি অনবরত সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর মুখের সুমুখে ধোয়ার একটি ছোটখাটো মেঘ জমে গিয়েছিল। তিনি একদৃষ্টে সেইদিকে চেয়ে ছিলেন,—এমন ভাবে, যেন সেই ধোঁয়ার ভিতর তিনি কোন নূতন তত্ত্বের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। পূর্ব পরিচয়ে আমাদের জানা ছিল যে, সোমনাথকে যখন সবচেয়ে অন্যমনস্ক দেখায়, ঠিক তখনি তাঁর মন সব চেয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকে, সে সময়ে একটি কথাও তার কান এড়িয়ে যায় না, একটি জিনিষও তার চোখ এড়িয়ে যায় না। সোমনাথের চাচাছোলা মুখটি ছিল ঘড়ির dial-এর মত, অর্থাৎ তার ভিতরকার কলটি যখন পূরোদমে চলছে তখনও সে মুখের তিলমাত্র বদল হত না, তার একটি রেখাও বিকৃত হত না। তার এই আত্মসংযমের ভিতর অবশ্য আর্ট ছিল। সীতেশ তার কথা শেষ করতে না করতেই সোমনাথ ঈষৎ কুঞ্চিত করলেন। আমরা বুঝলুম সোমনাথ তার মনের ধনুকে ছিলে চড়ালেন, এইবার শরবর্ষণ আরম্ভ হবে। আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। তিনি ডান হাতের সিগারেট বাঁ হাতে বদলি করে দিয়ে, অতি মোলায়েম অথচ অতি দানাদার গলায় তাঁর কথা আরম্ভ করলেন। লোকে যেমন করে গানের গলা তৈরী করে, সোমনাথ তেমনি করে কথার গলা তৈরী করেছিলেন,–সে কণ্ঠস্বরে কর্কশতা কিম্বা জড়তার লেশমাত্র ছিল না। তার উচ্চারণ এত পরিষ্কার যে, তাঁর মুখের কথার প্রতি-অক্ষর গুণে নেওয়া যেত। আমাদের এ বন্ধুটি সহজ মানুষের মত সহজভাবে কথাবার্তা কইবার অভ্যাস অতি অল্প বয়সেই ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর গোঁফ না উঠতেই চুল পেকেছিল। তিনি সময় বুঝে মিতভাষী বা বহুভাষী হতেন। তার অল্পকথা তিনি বলতেন শানিয়ে, আর বেশী কথা সাজিয়ে। সোমনাথের ভাবগতিক দেখে আমরা একটি লম্বা বক্তৃতা শোনবার জন্য প্রস্তুত হলুম। অমনি আমাদের চোখ সোমনাথের মুখ থেকে নেমে তার হাতের উপর গিয়ে পড়ল। আমরা জানতুম যে তিনি তাঁর আঙ্গুল কটিকেও তার কথার সৎ করতে শিখিয়েছিলেন।