ফরাসি বইখানির যা পড়ছিলুম, তা হচ্ছে একটি কবিতা
Si vous n’avez rien à me dire,
Pourquoi venir auprès de moi?
Pourquoi me faire ce sourire
Qui tournerait la tête au roi?
এর মোটামুটি অর্থ এই—”যদি আমাকে তোমার বিশেষ কিছু বলবার থাকে ত আমার কাছে এলেই বা কেন, আর অমন করে হাসলেই বা কেন, যাতে রাজারাজড়ারও মাথা ঘুরে যায়!”
আমি কি পড়ছি দেখে সুন্দরী ফিক করে হেসে উঠল। সে হাসির ঝাটা আমার মুখে লাগল, আমি চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলুম। আমার পড়া আর এগোলো না। ছোট ছেলেতে যেমন কোন অন্যায় কাজ করতে ধরা পড়লে শুধু হেলে-দোলে বাঁকে-চোরে, অপ্রতিভভাবে এদিক ওদিক চায়, আর কোনও কথা বলতে পারে না, আমার অবস্থাও তদ্রুপ হয়েছিল।
আমি বইখানি বন্ধ করে বৃদ্ধকে ডেকে তার দাম জিজ্ঞেস করলুম। সে বল্লে, এক শিলিং। আমি বুকের পকেট থেকে একটি মরক্কোর পকেট-কে বার করে দাম দিতে গিয়ে দেখি যে, তার ভিতর আছে শুধু পাঁচটি গিনি; একটিও শিলিংনেই। আমি এ-পকেট ও-পকেট খুঁজে কোথায়ও একটি শিলিং পেলুম না। এই সময়ে আমার নব-পরিচিতা নিজের পকেট থেকে একটি শিলিং বার করে, বৃদ্ধের হাতে দিয়ে আমাকে বললে—”তোমার আর গিনি ভাঙ্গাতে হবে না, ও-বইখানি আমি নেব।” আমি বল্লুম—”তা হবে না।” তাতে সে হেসে বললে—”আজ থাক, আবার যেদিন দেখা হবে সেইদিন তুমি টাকাটা আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে।”
এর পরে আমরা দুজনেই বাইরে চলে এলুম। রাস্তায় এসে আমার সঙ্গিনী জিজ্ঞাসা করলে—”এখন তোমার বিশেষকরে কোথায়ও যাবার আছে?” আমি বল্লুম—”না।”
–”তবে চল, Oxford Circus পর্যন্ত আমাকে এগিয়ে দাও। লণ্ডনের রাস্তায় একা চলতে হলে সুন্দরী স্ত্রীলোককে অনেক উপদ্রব সহ্য করতে হয়।”
এ প্রস্তাব শুনে আমার মনে হল, রমণীটি আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করলুম-”কেন?”
—”তার কারণ পুরুষমানুষ হচ্ছে বাঁদরের জাত। রাস্তায় যদি কোনও মেয়ে একা চলে, আর তার যদি রূপযৌবন থাকে, তাহলে হাজার পুরুষের মধ্যে পাঁচশ’জন তার দিকে ফিরে ফিরে তাকাবে, পঞ্চাশজন তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি হাসবে, পাঁচজন গায়ে পড়ে আলাপ করবার চেষ্টা করবে, আর অন্ততঃ একজন এসে বলবে, আমি তোমাকে ভালবাসি।”
—”এই যদি আমাদের স্বভাব হয় ত কি ভরসায় আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলেছ?”
সে একটু থমকে দাঁড়িয়ে, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে— “তোমাকে আমি ভয় করিনে।”
—”কেন?”
—”বাঁদর ছাড়া আর-এক জাতের পুরুষ আছে,যারা আমাদের রক্ষক।”
—”সে জাতটি কি?”
—”যদি রাগ না কর ত বলি। কারণ কথাটা সত্য হলেও, প্রিয় নয়।”
-”তুমি নিশ্চিন্তে বলতে পার–কেননা তোমার উপর রাগ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
—”সে হচ্ছে পোষা কুকুরের জাত। এ জাতের পুরুষরা আমাদের লুটিয়ে পড়ে, মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল্ করে চেয়ে থাকে, গায়ে হাত দিলে আনন্দে লেজ নাড়ায়, আর অপর-কোনও পুরুষকে আমাদের কাছে আসতে দেয় না। বাইরের লোক দেখলেই প্রথমে গোঁ গোঁ করে, তারপর দাঁত বার করে,—তাতেও যদি সে পিঠটান না দেয়, তাহলে তাকে কামড়ায়।”
আমি কি উত্তর করব না ভেবে পেয়ে বল্লুম—”তোমার দেখছি আমার জাতের উপর ভক্তি খুব বেশি।”
সে আমার মুখের উপর তার চোখ রেখে উত্তর করলে—”ভক্তি না থাক, ভালবাসা আছে।” আমার মনে হল তার চোখ তার কথায় সায় দিচ্ছে।
এতক্ষণ আমরা Oxford Circus-এর দিকে চলেছিলুম, কিন্তু বৈশীদূর অগ্রসর হতে পারি নি, কেননা দুজনেই খুব আস্তে হাঁটছিলুম।।
তার শেষ কথাগুলি শুনে আমি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলুম। তারপর যা জিজ্ঞেস করলুম, তার থেকে বুঝতে পারবে যে তখন আমার বুদ্ধিশুদ্ধি কতটা লোপ পেয়েছিল।
আমি।—”তোমার সঙ্গে আমার আবার কবে দেখা হবে?”
—”কখনই না।”
-”এই যে একটু আগে বললে যে আবার যেদিন দেখা হবে…”
—”সে তুমি শিলিংটে নিতে ইতস্ততঃ করছিলে বলে।”
এই বলে সে আমার দিকে চাইলে। দেখি তার মুখে সেই হাসি–যে-হাসির অর্থ আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি।
আমি তখন নিশীতে-পাওয়া লোকের মত জ্ঞানহারা হয়ে চলছিলুম। তার সকল কথা আমার কানে ঢুকলেও, মনে ঢুকছিল না।
তাই আমি তার হাসির উত্তরে বললুম—”তুমি না চাইতে পার, কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে আবার দেখা করতে চাই।”
—”কেন? আমার সঙ্গে তোমার কোনও কাজ আছে?”
—”শুধু দেখা-করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই!—আসল কথা এই যে, তোমাকে না দেখে আমি আর থাকতে পারব না।”
—”এ কথা যে-বইয়ে পড়েছ সেটি নাটক না নভেল?”
—”পরের বই থেকে বলছি নে, নিজের মন থেকে। যা বলছি তা সম্পূর্ণ সত্য।”
—”তোমার বয়সের লোক নিজের মন জানে না; মনের সত্য-মিথ্যা চিনতেও সময় লাগে। ছোট ছেলের যেমন মিষ্টি দেখলে খাবার লোভ হয়, বিশ-একুশ বৎসর বয়সের ছেলেদেরও তেমনি মেয়ে দেখলেই ভালবাসা হয়। ও-সব হচ্ছে যৌবনের দুষ্ট ক্ষিধে।”
—”তুমি যা বলছ তা হয় ত সত্য। কিন্তু আমি জানি যে তুমি আমার কাছে আজ বসন্তের হাওয়ার মত এসেছ, আমার মনের মধ্যে আজ ফুল ফুটে উঠেছে।”
—”ও হচ্ছে যৌবনের season flower, দুদণ্ডেই ঝরে যায়, —ও-ফুলে কোনও ফল ধরে না।”
—”যদি তাই হয় ত, যে ফুল তুমি ফুটিয়েছ তার দিকে মুখ ফেরাচ্ছ কেন? ওর প্রাণ দুদণ্ডের কি চিরদিনের, তার পরিচয় শুধু ভবিষ্যৎই দিতে পারে।”